Posts

চিন্তা

ট্রাম্পের নোবেল মনোনয়নের ‘যোগ্যতা’ কি আছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের?

June 21, 2025

কবির য়াহমদ

201
View

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসীম মুনির মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন দিয়েছেন, আহবান জানিয়েছেন, সুপারিশ করেছেন—এমন এক সংবাদের দেখা মিলল সোশ্যাল মিডিয়াসহ অনেক জায়গায়। রীতিমত ভাইরাল এটা।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণার বাইরেও ইত্তেফাক, বাংলাদেশ প্রতিদিন, যায়যায়দিন, কালবেলা, যমুনা টেলিভিশন, সময়ের আলো, ঢাকাপ্রকাশ, ঢাকা পোস্ট, জনকণ্ঠ, ইনকিলাব, সময় নিউজ, আজকের পত্রিকাসহ অনেকগুলো মিডিয়া আসীম মুনিরের নামের এই সংবাদ প্রকাশ করেছে। কেবল বাংলাদেশের মিডিয়াই নয়, ভারতেরও একাধিক মিডিয়া নোবেলের সুপারিশ/আহবানের সংবাদ প্রকাশ করেছে।

বিষয়টি বিভ্রান্তিকর, কারণ কোনো দেশের সেনাপ্রধান নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে কাউকে মনোনয়ন দিতে অথবা সুপারিশ করতে পারেন না। তবে ওই সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপ্রধান হলে সেক্ষেত্রে দিতে পারেন।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসীম মুনির আমেরিকায় গিয়ে এ-বিষয়ে পৃথক মন্তব্য/বক্তব্য দিতে পারেন, কিন্তু সুপারিশ অথবা মনোনয়ন দিতে পারেন না, কারণ মনোনয়ন দেওয়ার যোগ্যতা কোনো দেশের কোন সেনাপ্রধান রাখেন না।

কিছু মিডিয়া দেখলাম লিখেছে: “নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করল পাকিস্তান”।  ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদনে লিখেছে: পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে তাদের এক্স অ্যাকাউন্টে শুক্রবার (২১ জুন) লিখেছে, “পাকিস্তান সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করল। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের কারণে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করেছে।” পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল অসীম মুনিরের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার দেখা করেন ট্রাম্প। এরপরই দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা আসল।

ফক্স নিউজ ২১ জুন ফেসবুক ক্যাপশনে লিখেছে: Pakistan formally nominated President Trump for the 2026 Nobel Peace Prize “in recognition of his decisive diplomatic intervention and pivotal leadership during the recent India-Pakistan crisis.” অর্থাৎ “সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংকটের সময় তাঁর দৃঢ় কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ” পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে।

অধিকাংশ মিডিয়া পাকিস্তানের সেনাপ্রধান অথবা রাষ্ট্রীয় সূত্র উল্লেখ করে বলতে চায়, ২০২৬ সালের শান্তিতে নোবেলের জন্যে মনোনয়ন দিয়েছে পাকিস্তান। কেউ কেউ সাল উল্লেখ না করে বলছে, সেনাপ্রধান সুপারিশ করেছেন, মনোনয়ন দিয়েছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মনোনয়ন প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি; এটা শুরু হয় প্রতি বছরের সেপ্টেম্বরে। এই হয়েছে শব্দের ব্যবহার আদতে ‘মিসলিডিং’। কারণ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়া এক জিনিস, আর মনোনয়ন দেওয়া অন্য জিনিস।

নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটে Who can nominate? অংশে বলা রয়েছে: “প্রতি বছর, হাজার হাজার একাডেমির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, পূর্ববর্তী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য ব্যক্তিদের আগামী বছরের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই মনোনয়নকারীদের এমনভাবে নির্বাচন করা হয় যাতে সময়ের সাথে সাথে যতটা সম্ভব বিভিন্ন দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। সমস্ত মনোনয়ন গ্রহণের পর, চারটি পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নোবেল কমিটিগুলো প্রার্থী নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব পালন করে।”

এই মনোনয়নের প্রস্তাব দিতে পারেন জাতীয় সংসদের সদস্য, মন্ত্রী, বা রাষ্ট্রপ্রধান, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বা স্থায়ী সালিশি আদালতের সদস্য, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, আইন, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রেক্টর, বা শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, পূর্ববর্তী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত সংস্থার বোর্ডের সদস্য এবং নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির বর্তমান বা প্রাক্তন সদস্য।

২০২৫ সালের জন্যে শান্তিতে নোবেলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে এ-বছরের ফেব্রুয়ারিতেই। নিয়ম অনুযায়ী, পরের বছরের নোবেলের মনোনয়ন শুরু হবে সেপ্টেম্বর থেকে এবং চলতে থাকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

দ্য নোবেল পিস প্রাইজ ওয়েবসাইটে  ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, “২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মোট ৩৩৮ জন প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি এবং ৯৪টি সংস্থা। গত বছরের তুলনায় এটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। ২০২৪ সালে মোট ২৮৬ জন প্রার্থী মনোনীত হয়েছিলেন। সর্বাধিক সংখ্যক মনোনয়ন ছিল ২০১৬ সালে, যখন ৩৭৬ জন প্রার্থী ছিলেন। ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নের শেষ তারিখ ছিল ৩১ জানুয়ারি। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সদস্যরা তাদের প্রথম বৈঠকে আরও নাম যোগ করতে পারেন, যা এই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

নোবেল কমিটি মনোনীত প্রার্থীদের নাম নিশ্চিত করে না, না মিডিয়ার কাছে, না প্রার্থীদের নিজেদের কাছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থীদের নাম মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, হয় নিছক জল্পনার কারণে, অথবা কোনো ব্যক্তি নিজে নির্দিষ্ট প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কথা জানান। নোবেল ফাউন্ডেশনের নিয়ম অনুযায়ী, নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনীতদের তালিকা পুরস্কার প্রদানের ৫০ বছর পর প্রকাশ করা হয়।”

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে শান্তিতে নোবেল নিয়ে অনেক আগ্রহ অনেকের। আগেও ট্রাম্প মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ২০২৫ সালের জন্যেও মনোনয়ন পেয়েছেন। মার্কিন কংগ্রেসম্যান ড্যারেল ইসা ৪ মার্চ এক এক্স-পোস্টে লিখেছেন: “Today I will nominate @realDonaldTrump for the Nobel Peace Prize. No one deserves it more.” অর্থাৎ আজ আমি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেব। তিনিই এর সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।

May be an image of ‎2 people and ‎text that says '‎Rep. Darrell Issa 2,730 posts Q Rep. Darrell Issa @repdarrellissa Follow Official Congressional Account for Congressman Darrell Issa. Father. Tech Entrepreneur. Congressman from California. California's 48th District 203 Following ට issa.house.gov 227.3K Followers Joined August 2009 Posts Replies Highlights Media Pinned Rep. Darrell Issa @repdarrellissa Mar 4 Today will nominate @realDonaldTrump for the Nobel Peace Prize. No one deserves it more. 18K t7 10K 70K اوا 10M‎'‎‎

কংগ্রেসম্যান ড্যারেল ইসার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে  তার মনোনয়ন দেওয়ার তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। এতে লেখা হয়: “রোনাল্ড রিগ্যানের পর থেকে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট শান্তি বা যুদ্ধবিহীন বিশ্বের মৌলিক আদর্শকে এতটা ভালোভাবে প্রতিনিধিত্ব করেননি। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন ও তার শপথ গ্রহণের ১০ সপ্তাহেরও বেশি আগে – বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি বাস্তব হতে শুরু হয়েছে, এবং আমরা ইতিমধ্যে এর সুফল দেখতে পাচ্ছি। আমি আশা করি কমিটি এই অসাধারণ বিষয়ের প্রতি নজর দেবে এবং স্বীকৃতি দেবে।”

ড্যারেল ইসা নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির কাছে চিঠি লিখে এই মনোনয়ন দিয়েছেন বলে ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে।

কেবল ড্যারেল ইসাই নন, আরও কয়েকজন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ-বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আর ট্রাম্প এবারই প্রথম নোবেলের জন্যে মনোনয়ন পেয়েছেন এমন না, আগেও পেয়েছেন একাধিকবার। তবে পুরস্কার জুটেনি তার।

মজার বিষয় হচ্ছে, মনোনয়ন দেওয়ার ‘যোগ্যতা’ না থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে নিয়ে এই ব্যঙ্গ আমাদের দেশের অনেকেই সিরিয়াস ভাবে নেওয়া শুরু করেছে। কিছু মিডিয়াও ওখানে তাল দিচ্ছে!

এবার শুরুর প্রশ্ন “ট্রাম্পের নোবেল মনোনয়নের যোগ্যতা কি আছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের”; এর উত্তর খুঁজি। উত্তর হচ্ছে—‘নাই’!

কবির য়াহমদ
২১ জুন ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login