দাদি তৃষার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর অথচ গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন—
“এই ডায়মন্ড সেটটার দাম কিন্তু এক কোটি টাকারও বেশি, মা। তোমার দাদাকে আমি বলেছিলাম, এমন কিছু চাই যা এক ঝলকেই সবাইকে থামিয়ে দেবে। উনি আমার পছন্দ বুঝতেন… তখনকার দিনে এই ডিজাইন বানানোই ছিল বিশাল ব্যাপার।”
তৃষা বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল—
“এত দামী? আপনি তখনই জানতেন এমন ডিজাইন একদিন দরকার হবে?”
দাদি মুচকি হেসে বললেন—
“জানতাম না মা, কিন্তু আজ যখন তোমার গায়ে পরবে তখন বুঝব—হয়তো সেদিন থেকেই এই দিনটার জন্য তোলা ছিল।”
তৃষা একটু থমকে, আবেগ চেপে বলল—
“আমি খুব সৌভাগ্যবান, দাদি।”
দাদি আদর করে বললেন—
“সৌভাগ্য নয়, তুমি আমাদের ঘরের আশীর্বাদ।”
তৃষা ধীরে ধীরে রুমে ঢুকলো। হাতে দাদির দেওয়া ডায়মন্ড সেট আর ম্যাচিং শাড়িটা। চোখেমুখে এক ধরণের শান্ত অথচ মৃদু উত্তেজনা।
রুমটা ছিল বিশাল, আধুনিক কিন্তু আভিজাত্যে ভরপুর। একপাশে ছিল ঘন কাঠের বুকশেলফ ঘেরা স্টাডি কর্নার, যেখানে বসে ছিলেন মিস্টার আমান। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তাঁর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, তবুও মনোযোগ কাজেই।
তৃষা সামনে এসে একটু থেমে বলল—
“আমি দাদির রুম থেকে এলাম। উনি কিছু দিতে চাইলেন... বললেন এটা যেন কাল রিসেপশনে পরি।”
মিস্টার আমান চোখ তুলে তাকালেন। তৃষা ধীরে ধীরে ছোট টেবিলের ওপর রাখা ছোট বাক্সটা খুলে দিলো। সবুজ ডায়মন্ডের সেই অনন্য সেটটা আলোয় ঝলসে উঠল। তার পাশে শাড়িটাও তুলে ধরলো—একটা সমুদ্র-সবুজ মিহি রেশমে হাতে কাজ করা রাজকীয় শাড়ি।
তৃষা বলল—
“দাদি বললেন এই সেটের দাম এক কোটি টাকারও বেশি। আপনি জানেন? আমি এত দামি কিছু কখনও হাতে নিইনি।”
মিস্টার আমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে পড়লো শুধু দামি গয়না নয়—তৃষার চোখে একরকম দ্বিধা, অভিমান আর হঠাৎ করে আসা এক নতুন জীবনের ভার।
তিনি শান্ত গলায় বললেন—
“তোমার গায়ে খুব মানাবে… শুধু গয়না নয়, এই শাড়িটাও। কিন্তু তার চেয়ে বেশি মানাবে তোমার চোখের এই সরলতা।”
তৃষা একটু অবাক হয়ে তাকালেন। কিছু বলার চেষ্টা করলেন না। কেবল তাকিয়ে রইলেন।
মিস্টার আমান একটু থেমে আবার বললেন—
“যা হোক, কাল তোমার জন্য বড় দিন। আমি চাই তুমি যেন হাসতে পারো। অন্তত একটু। সেটা যদি আমার পাশে থেকেও না পারো, তাও কিছু মনে করবো না।”
এই মুহূর্তটা যেন ঘরের নরম আলোয় এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে উঠলো।
তৃষার কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু তার মধ্যে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ঝরে পড়ছিল।
সে নিচু গলায় বললো—
“আমি দাদীর মন রাখার জন্যই এই গয়না আর শাড়িটা পরবো কাল। কিন্তু একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখছি, আমি এসব জিনিসকে কখনো নিজের মনে করছিনা।”
মিস্টার আমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর একটুখানি মাথা নিচু করে, গলার স্বর ঠাণ্ডা রেখে বললেন—
“ধন্যবাদ, তৃষা। আপনার স্পষ্ট কথার জন্য।”
তৃষার চোখে এক মুহূর্তের জন্য একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু সেটা কষ্টে ঢাকা পড়ে গেল। সে মুখ ঘুরিয়ে শাড়িটা গুছিয়ে রাখলো।
মিস্টার আমান একটু অপস্তুত হয়ে চেয়ারে পেছনে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর চোখে তখন একটা অদ্ভুত অনুভব—এই মেয়েটা, যে এখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, সে যেন খুব কাছে থেকেও বহু দূরে।
মিস্টার আমান বুঝতে পারছিলেন তৃষার মনের মধ্যে কী রকম দ্বন্দ্ব চলছে। তাই একটু নরম হয়ে, ধীর স্বরে বললেন—
"আমি আপনার কথায় ধন্যবাদ দিইনি, তৃষা। আমি ধন্যবাদ দিয়েছি কারণ আপনি দাদীর মনের যত্ন নিচ্ছেন। আমাদের এই চুক্তির কথা দাদী জানলে তিনি কতটা কষ্ট পাবেন, তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আপনি সেই কথা মাথায় রেখে সব কিছু করছেন—তাই ধন্যবাদ। আবারও বলছি, সত্যি ধন্যবাদ।"
তৃষা কিছু বললো না, কেবল একবার চোখ তুলে তাকালো মিস্টার আমানের দিকে। মনের গভীর থেকে একটা মৃদু সম্মানবোধ তার চোখে ফুটে উঠেছিল।
একটু পরে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো—
"আমি দাদীকে কষ্ট দিতে চাই না। এই সম্পর্কটা যা-ই হোক, কিছু সম্পর্ককে সম্মান জানানো উচিত।"
মিস্টার আমান আর কিছু বলেননি, শুধু চুপচাপ মাথা নেড়ে নিজের কাজে মন দিলেন।
চলবে......