অপেক্ষার শেষ নেই
লেখক: শিহাবুজ্জামান শাওন
⸻
ছোট্ট এক শহরের নিস্তরঙ্গ বিকেল।
এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো একটা চায়ের দোকান—নাম “স্মৃতির ধোঁয়া”।
দোকানটার টিনের ছাউনি কিছুটা মরিচা ধরা, ভাঙা বেঞ্চগুলো বহুদিনের বসার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে।
এই শহরে কেউ আর খুব একটা আসে না এই দোকানে, তবুও এক লোক রোজ নিয়ম করে আসে। প্রতিদিন। বছরের পর বছর।
তার নাম শাওন।
বয়স পঁয়ত্রিশের ঘরে, চোখে চিন্তার রেখা, মুখে অতীতের ছায়া।
সে প্রতিদিন বসে এক কোণায়—একই টেবিলে। সামনে থাকে দুটি চায়ের কাপ।
একটাতে সে চুমুক দেয়, অন্যটা থাকে পরে।
কেউ জানে না, সেটা সে কার জন্য রাখে।
তবে দোকানের পুরনো কর্মচারীরা জানে—ওটা তাসফিয়ার জন্য।
⸻
সময়টা ছিল ২০১৮ সালের এক শীতের সন্ধ্যা।
চায়ের দোকানটায় তখন নিয়মিত সাহিত্যপ্রেমীরা আড্ডা দিত।
সেদিন এক সাহিত্য সভা শেষে এখানে ঢুকেছিল দু’জন—শাওন ও তাসফিয়া।
শাওন তখন সদ্য উদীয়মান এক লেখক, স্বপ্ন দেখে বড় লেখক হওয়ার।
আর তাসফিয়া—একজন পাঠক, যার চোখে ছিল কবিতার ছায়া, আর কথায় ছিল একধরনের বিষণ্নতা।
প্রথম পরিচয়ে তাসফিয়া বলেছিল,
“এই শহরে এমন একটা জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানে কেউ গল্প শোনে। শুধু লেখে না।”
শাওন তাকিয়ে বলেছিল,
“তুমি গল্প খুঁজো, আমি লিখি—চলো, আমাদের গল্পটা এখানেই শুরু হোক।”
তারপর শুরু হয় এক অলিখিত প্রেম।
তারা প্রতিদিন এই দোকানে বসে গল্প করে, চা খায়, কবিতা পড়ে—
তাসফিয়া বলত,
“একদিন তুমি অনেক বড় লেখক হবে। আর আমি হবো তোমার গল্পের প্রথম পাঠক।”
⸻
কিন্তু জীবনের গল্প কখনো নিজের কলমে লেখা যায় না।
তাসফিয়ার পরিবার একদিন ঠিক করে—তার বিয়ে হবে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে, যার পোস্টিং বিদেশে।
তাসফিয়া কেঁদে বলেছিল,
“শাওন, আমি চাই না আমাদের গল্পটা এখানে থেমে যাক।
কিন্তু আমি আমার পরিবারকেও ভাঙতে পারি না।
তারা যা বলছে, আমি মানতে বাধ্য।”
শাওন কিচ্ছু বলেনি।
তার চোখে তখন অজস্র প্রশ্ন, কিন্তু ঠোঁটে শুধু একটুকরো নিরবতা।
সেদিনই শেষবার তারা বসেছিল “স্মৃতির ধোঁয়া” দোকানে।
তারপর, তাসফিয়া চলে যায় এক অজানা জীবনে।
শাওন থেকে যায় তার পুরনো চায়ের কাপে—একটা চুমুক আর একটা অপেক্ষা।
⸻
পাঁচ বছর কেটে গেছে।
শাওন আর লিখে না।
তার সর্বশেষ লেখা ছিল—“তোমার অপেক্ষায় আমি নিজের গল্প থামিয়ে দিয়েছি।”
সে চাকরি নেয়নি, প্রেম করেনি, শহর ছাড়েনি।
দোকানের মালিক মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই, আপনি কাকে এতদিন ধরে খালি চা খাওয়াচ্ছেন? কেউ তো আসে না!”
শাওন মৃদু হেসে বলে,
“সে চা খেতে ভালোবাসত।
আমি না ভালোবাসলেও, তার অভ্যেসটা রেখে দিয়েছি।
চা খেলেই মনে হয়, সে এখানেই বসে আছে… এক কোণায়।”
⸻
একদিন বিকেলে হঠাৎ—সবকিছু পালটে যায়।
দোকানে ঢোকে এক নারী।
সাদা শাড়ি পরা, চোখে রিমলেস চশমা, হাতে ছোট্ট এক বাচ্চা মেয়ের হাত।
শাওন মাথা তুলে তাকায়—তার হৃদয় থমকে যায়।
তাসফিয়া।
তিন বছর আগে যার চোখে সে তার সমস্ত স্বপ্ন দেখেছিল, সে আজ সামনে।
চোখে বয়সের ছাপ, মুখে ক্লান্তি, কিন্তু সেই পুরনো পরিচিত হাসি।
তাসফিয়া এগিয়ে এসে বলল,
“এই শহরে এসেছি কয়েক দিনের জন্য। ভেবেছিলাম, একবার এই চায়ের দোকানটা দেখে যাই।
তুমি এখনো কি… এখানে বসো?”
শাওন টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চা এখনো দুই কাপ অর্ডার দিই।
অভ্যেস হয়ে গেছে।”
তাসফিয়া বসে না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে।
তার মেয়েটা এক পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে—জানেই না, এই টেবিলে আজ কতটা ইতিহাস জমে আছে।
তাসফিয়া নিচু গলায় বলল,
“ভালো থেকো শাওন।
জীবন আমাদের যা দিয়েছে, তা নিয়ে বাঁচতে হয়।
কিন্তু জানো? আমি এখনো তোমার সেই গল্প পড়ি, যেখানে তুমি লিখেছিলে—‘তুমি গল্প থামিয়ে দিয়েছো।’
আমারও অনেক গল্প থেমে গেছে…”
তার চোখ ভিজে ওঠে।
শাওন কিছু বলে না, শুধু এক ফোঁটা পানি চা-কাপের ধোঁয়ার ভেতর মিশে যায়।
তাসফিয়া মেয়ের হাত ধরে চলে যায়।
সাদা শাড়ির ছায়া মিলিয়ে যায় দোকানের ধুলো মেশানো বাতাসে।
⸻
টেবিলে তখনো দুই কাপ চা।
একটা আধা খাওয়া, আরেকটা পূর্ণ—অপেক্ষার মতো।
⸻
🌸 শেষ কথা:
ভালোবাসার সব গল্পের শেষ হয় না বিয়ে দিয়ে বা মিলনে।
কিছু ভালোবাসা থেকে যায়… এক কাপ চায়ের মতো—যার ধোঁয়ার ভেতর একটা মুখ ভেসে থাকে,
কখনো স্পষ্ট হয় না, কিন্তু হারায়ও না।
এমন কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আসে, যারা থেকে যায়—শুধু অভ্যেস হয়ে