গল্প: “শেষ চিঠি”
লেখক :শিহাবুজ্জামান শাওন
⸻
রাত তখন গভীর। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে কিছু কুকুরের ডাক আর দূরের ট্রেনের হুইসেল—জানিয়ে দিচ্ছে শহরটা এখনো পুরো ঘুমায়নি। চারতলার ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে শাওন। তার চোখে কোনো রঙ নেই, ঠোঁটে কোনো হাসি নেই, শুধু এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসের বর্ণহীন ঢেউ।
তার পাশে রাখা পুরনো ডায়েরিটার প্রথম পাতায় বড় হরফে লেখা— “তাসফিয়া”।
তিন বছর আগে ঠিক এই রাতেই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসন্ত উৎসব। সবার হাতে পিচকারি, মুখে রঙ। গানের সুরে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রাণ। শাওন সবের মাঝখানে একা। চুপচাপ, মুখ গোমড়া করে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভিড় এড়িয়ে চলত, শব্দ তাকে ক্লান্ত করত। তার কাছে ভালোবাসা ছিল বইয়ের পাতার শব্দ, বাস্তবতার নয়।
সেই ভিড়েই হঠাৎ একটা মেয়ে পেছন থেকে এসে তার গালে রঙ লাগিয়ে বলেছিল—
“এই পৃথিবীটা তো এত সুন্দর! তুমি কেন চুপচাপ থাকো?”
মেয়েটির চোখে ঝলমলে আলো। সেই চোখেই সে যেন পুরো পৃথিবীর কথা বলে ফেলেছে। শাওন অবাক হয়েছিল, বিভ্রান্ত হয়েছিল, আর ধীরে ধীরে হারিয়েও গিয়েছিল তার সেই চোখের দৃষ্টিতে।
তার নাম ছিল তাসফিয়া।
সেই বিকেলটা, সেই মুহূর্তটাই বদলে দিয়েছিল শাওনের পৃথিবী।
তাসফিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম—সবকিছু যেন এক রূপকথার মতো। প্রতিদিন বিকেলে তারা হাঁটত ক্যাম্পাসের লেকের পাড়ে, বসত একই বেঞ্চে, আর স্বপ্ন বুনত ভবিষ্যতের।
তাসফিয়া বলত,
“শাওন, একদিন আমাদের গল্পটা সবাই জানবে। আমরা এমন একটা জীবন গড়বো, যেখানে কেবল ভালোবাসাই থাকবে। আমি তো চাই, আমাদের সন্তানদের বলবো— এই জায়গায় তোমার বাবা আমাকে প্রথম চুমু দিয়েছিল!”
শাওন হেসে বলত,
“তুমি না থাকলে আমি কিছুই না। আমি কল্পনা করতে পারি না এমন একটা জীবন যেখানে তুমি নেই।”
তাদের ভালবাসা ছিল নির্মল, অটুট—যেন একটা নদী, যার গন্তব্য জানা নেই, কিন্তু প্রবাহ থেমে নেই। কিন্তু জীবন কি কখনও এমনভাবে চলে?
শেষ বর্ষে এসে একদিন হঠাৎ তাসফিয়া চুপচাপ হয়ে গেল। ফোনের ওপাশে শুধু নিঃশ্বাস শোনা যেত, কথা নয়। একদিন সে বলল—
“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবার ঠিক করেছে। পাত্র দেশের বাইরে থাকে… প্রতিষ্ঠিত, ধনী… আমি কিছু বলতে পারিনি শাওন… আমি জানি না কী করবো…”
শাওনের পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল— সে লড়বে। সে লিখেছিল চিঠি, ফোন করেছিল, কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে পর্যন্ত গিয়েছিল, কাউন্সেলিং চেয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছুই কাজ করেনি।
তাসফিয়া বলেছিল শেষবার—
“শাওন, আমি তোমাকে ভালোবাসি… কিন্তু আমি আমার পরিবারকে বেছে নিলাম। আমার মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি তাদের দুঃখ দিতে পারি না। আমি আমার ভালোবাসাকে বিসর্জন দিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।”
বিয়ের দিন ফেসবুকে তাসফিয়ার ছবি দেখেছিল শাওন— পরনে বেনারসী, গলায় গয়না, ঠোঁটে হালকা হাসি।
কিন্তু চোখে কোনো পানি ছিল না—ছিল একটা চাপা কষ্ট, যেটা শুধু একজন ভালোবাসার মানুষই বুঝতে পারে।
তারপর কেটে গেছে এক বছর।
শাওন প্রতিদিন সকালবেলা সেই লেকের পাড়ে যায়, যেখানে তারা বসত। হাতে নিয়ে যায় পুরোনো সেই ছবি—তাসফিয়া আর তার প্রথম সেলফি। প্রতিদিন রাতে লিখে একটি করে চিঠি, কিন্তু কখনো পাঠায় না। ডায়েরির পেছনের পাতা গুলোতে জমে আছে শত শত অপাঠিত চিঠি—তাসফিয়ার নামে লেখা, কিন্তু কোনো প্রাপকের ঠিকানাহীন।
আজকের রাতটা একটু বেশি নিঃশব্দ। কারণ আজ তাসফিয়ার জন্মদিন।
শাওন পুরোনো চিঠিগুলো ছড়িয়ে রেখেছে বিছানায়। একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছে। কিছুতে চোখের পানি, কিছুতে হাতের কাঁপন।
ডায়েরির শেষ পাতায় সে লিখেছে নতুন একটি চিঠি—
⸻
“প্রিয় তাসফিয়া,
আজ তোমার জন্মদিন।
জানো, এখনো আমি তোমার পছন্দের সেই বাদাম চকলেট খাই না। সেই গানটা শুনি না, যেটা তুমি গুনগুন করতে। কারণ এগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি কাকে হারিয়েছি।
তুমি বলেছিলে, একদিন আমাদের গল্পটা সবাই জানবে। এখন সবাই শুধু ভাবে, আমি পাগল হয়েছি… যে এক বছর ধরে এক পুরোনো প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু জানো, আমি তোমার অপেক্ষায় বাঁচি। এই পৃথিবীতে সবাই বলে— মানুষ ভুলে যায়। আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে চাই।
তোমার চোখে আমি প্রথম নিজেকে দেখেছিলাম। এখন আয়নায় তাকালে দেখি— আমি কেবল একটা ছায়া। কিন্তু তবুও বেঁচে আছি। কারণ তুমি বলেছিলে— ‘নিজেকে শেষ কোরো না।’
তুমি সুখী হও—এটাই আমার চাওয়া। আমি জানি, তোমার চারপাশে এখন অনেক কিছু, হয়তো সুখের ভান, হয়তো সত্যিকারের শান্তি। জানি না। শুধু জানো, এখানে একটুকু মন আজও তোমায় ভালোবাসে… নিঃশব্দে, নিঃশর্তে।
শুভ জন্মদিন, তাসফিয়া।
তোমার,
শাওন।”
⸻
চিঠিটা শেষ করে শাওন তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। একটা তারা খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে আজ। হয়তো ওটাই তাসফিয়ার হাসি। হয়তো সে এখন ঠিক এই মুহূর্তে হাসছে, দূরে কোথাও… নিজের সংসারে।
কিন্তু এই ছাদে, এই শহরে, এই রাতে—একটা হৃদয় এখনো অপেক্ষায়।
⸻
শেষ কথা:
ভালোবাসা মানে কেবল একসাথে থাকা নয়। ভালোবাসা মানে কারো জন্য নিঃশব্দে অপেক্ষা করা, তার সুখে নিজের সব কষ্ট হারিয়ে ফেলা। সম্পর্ক ভেঙে গেলেও যারা সত্যিকারের ভালোবাসে—তারা ভুলে যায় না।
তারা প্রতিদিন ভালোবাসে… নিঃশব্দে
,,,,,,
চলবে,,