গল্প: “শেষ চিঠি – দ্বিতীয় পর্ব: এক ফোঁটা আলো”
⸻লেখক : শিহাবুজ্জামান শাওন
তাসফিয়ার জন্মদিনের রাতে শেষ চিঠিটা লেখার পর শাওন যেন এক ধরনের মুক্তি অনুভব করেছিল।
চিঠিটা সে রেখে দিয়েছিল সেই পুরনো ডায়েরিতে। তারপর ছাদ থেকে নিচে নেমে এসেছিল—কিন্তু কেমন যেন হালকা অনুভব হচ্ছিল ভেতরে।
পরদিন সকালে সে আবার সেই লেকের পাড়ে গিয়েছিল। সবদিনের মতো একাই বসেছিল। কিন্তু আজ তার পাশে কেউ বসে ছিল।
নতুন মুখ। মেয়েটা বই পড়ছিল—হুমায়ূন আহমেদের “নন্দিত নরকে”।
মেয়েটি হঠাৎ শাওনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“আপনিও কি প্রতিদিন এখানে আসেন?”
শাওন একটু থমকে গিয়েছিল। অনেকদিন পর কেউ তাকে প্রশ্ন করেছে। সে মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ… অভ্যেস হয়ে গেছে।”
মেয়েটির নাম ছিল মায়া।
শাওন জানে না কেন, কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগেনি।
মায়াও নিঃসঙ্গ ছিল—নতুন শহরে চাকরি পেয়েছে, বন্ধুবান্ধব নেই, তাই বই-লেক আর নিজের চিন্তায় ডুবে থাকে।
প্রথম কয়েকদিন তারা শুধু “হ্যালো” বলত। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল কিছু ছোট্ট কথাবার্তা।
কিছুদিন পর, মায়া হেসে বলল,
“আপনার চোখে একটা কষ্ট আছে… আপনি কি কাউকে হারিয়েছেন?”
শাওন চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“হারায়নি… শুধু ফিরে পায়নি।”
মায়া কোনো প্রশ্ন করেনি। শুধু একটা কথা বলেছিল—
“ভালোবাসা ফিরে না এলেও… জীবন থেমে যায় না। আমরা নিজের সঙ্গে নতুন গল্প লিখতে পারি, যদি মন চায়।”
সেদিন রাতে শাওন ডায়েরি খুলেছিল। প্রথমবার, তাসফিয়ার চিঠিগুলোর পাশে নতুন একটি নাম লিখল—
“মায়া”।
⸻
সময় কেটে যাচ্ছিল।
মায়ার সঙ্গে শাওনের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল। মায়া কখনো তাসফিয়ার জায়গা নিতে চায়নি। সে শুধু একটা নতুন বন্ধু ছিল, যে বুঝত কষ্টের ভাষা।
একদিন মায়া বলল,
“তোমার লেখার কথা শুনেছি… এখন আর লেখো না?”
শাওন মাথা নেড়ে বলল,
“লিখতে ভয় পাই… মনে হয় যদি সে পড়ে…”
মায়া হেসে বলল,
“তুমি লেখো। ভালোবাসা হারালে তা লিখে ফেলো—তবেই তো মন হালকা হয়। মনে রেখো, যারা আমাদের ভেঙে দেয়, তারাই আমাদের সবচেয়ে বড় গল্পে পরিণত হয়।”
সেদিন রাতে শাওন লিখেছিল নতুন গল্প—
“শেষ চিঠি” নামে একটি ছোট গল্প।
তাসফিয়ার কথা, তার ভালোবাসা, তার চলে যাওয়া… সব কিছু সে লিখে ফেলেছিল। চোখের পানি দিয়ে ভিজিয়েছিল পৃষ্ঠা, কিন্তু শেষ লাইনে লিখেছিল—
“আমি এখন আর তাসফিয়ার অপেক্ষায় নেই। আমি এখন নিজের অপেক্ষায় আছি।”
⸻
এক বছর পর…
শাওনের লেখা গল্প একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশ পায়। পাঠকরা দারুণভাবে গ্রহণ করে।
শাওন আবার লিখতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার পুরনো পরিচিত বন্ধুরা ফিরে আসে।
একদিন এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে শাওনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে মঞ্চে উঠে তার প্রথম লেখা “শেষ চিঠি” পড়ে শোনায়।
সেদিন মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মায়া—চোখে জল, ঠোঁটে হাসি।
অনুষ্ঠান শেষে মায়া কাছে এসে বলল,
“তুমি তাকে ভুলে যাওনি, কিন্তু নিজেকে পেয়েছো। এটা সবচেয়ে বড় জয়। আমি গর্বিত তোমার জন্য।”
⸻
✨ শেষ কথা:
কিছু ভালোবাসা ফিরে আসে না, কিন্তু সেগুলো আমাদের ভেতরে এমন কিছু গড়ে তোলে—যা থেকে নতুন জীবন তৈরি হয়।
শাওন হয়তো তাসফিয়াকে হারিয়েছে, কিন্তু সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে—একজন লেখক, একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, একজন জীবনযোদ্ধা হিসেবে।
,,,,,
চলবে,,,,,,,,