Posts

ভ্রমণ

পিকিং থেকে ওয়েনজু: চীন ভ্রমণের স্মৃতিকথা (পর্ব ২)

June 26, 2025

রাশিক তাহির

148
View

২. ফ্লাইট নং ৮০১০

পৃথিবীতে আমি মায়ার খোঁজে থাকি। গভীর রাতের যাত্রাগুলো অত্যন্ত মায়াবী হয়। ফ্লাইট নং ৮০১০ আমার কাছে তেমন-ই মায়াবী বলে মনে হলো। জানালার বাইরে আঁধারে মায়া ঝড়ছে, প্লেনের ভেতরেও সব লাইট বন্ধ। ততক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে কোন এক শিশু কেঁদে উঠছে। অন্যরা বিরক্ত হলেও আমার কাছে তা গাঢ় অন্ধকারে মানব অস্তিত্বের প্রতীক। শিশুটি কান্না বন্ধ করে দিলেই যেন নীরবতার গান বেজে ওঠে। 

তবে ঘন্টাখানেক পরেই কেবিনের সব লাইট জ্বলে উঠলো। সামনে থেকে দু'জন কেবিন ক্রু-ও পেছনের দিকে হেঁটে গেল। বুঝতে পারলাম রিফ্রেশমেন্ট ড্রিঙ্কস দিবে, সঙ্গে সর্বোচ্চ কিছু স্ন্যাকস। আমি তখন সামনে কোন শূন্যে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। হুট করে আমাদের তিন সিট পরেই একটি পর্দা টেনে দিলো একজন কেবিন ক্রু। এখানে যে একটি পর্দা আছে তা আমি খেয়াল-ই করিনি। বুঝতে দেরি হলো না পর্দার ওপারের চার সারির পাঁচ কলামের সিটগুলো‌ বিজনেস ক্লাসের। কাঁচের প্লেটে স্টিলের চামচের শব্দ পেয়ে বুঝতে পারলাম তাদেরকে ডিনার সার্ভ করা হচ্ছে। 

মিনিট দশেক পরে দু'জন কেবিন ক্রু একটি চলন্ত ট্রে টানতে টানতে সামনে আসলো‌। ট্রের ওপরে রয়েছে নানারকমের ড্রিঙ্কস এবং জুস। জিজ্ঞেস করলো আমি কী খেতে চাই। বললাম কল্ড ড্রিঙ্কস। তাই দিলো। এভাবে তারা প্রতিটি সিটে গিয়ে সবাইকে তাদের মনমতো ড্রিঙ্কস এবং জুস দিয়ে ফের পেছনে চলে গেল। তখন ক্ষুধায় আমার পেটে শুধু ইঁদুর নয়, কত রকম প্রাণীর যে ডাক শোনা যাচ্ছিল– সে বিষয়ে আর নাই বা বললাম। এমন সময়ে আমার মস্তিষ্কে দু'ধরনের চিন্তা মাথায় আসে– এক. পুঁজিবাদ আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে! খাদ্যের জন্যও সম্পদশালী হতে হয়, এবং দুই. আমার যদি অনেক টাকা থাকতো!  

কিন্তু আমার সেই চিন্তার ঘোর ভেঙে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দুজন কেবিন ক্রু ফিরে আসলো। এবারও তাদের সঙ্গে ট্রে। জিজ্ঞেস করলো কী খেতে চাও– বিফ উইথ নুডলস ওর রাইস? আমি আর দেরী না করে বললাম রাইস। খাবার হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে খেয়াল করলাম ক্ষুধার্ত আমি একা না– বরং মা-বাবা, চাচা-চাচী, এমনকি আমার দুই ভাই-বোনের আমার মতই অবস্থা। রাইসের সঙ্গে তারা আরো কিছু দিয়েছিল। যেমন– গাজর, বন রুটি, ইত্যাদি। মনে মনে কৃতজ্ঞবোধ করলাম। গরীব-দুঃখীদেরও খাবারের ব্যবস্থা চীন করে। 

মোটামুটি সবাই-ই পেট ভরে খেলাম। এবার কেবিন ক্রু-রা আবার আসলো– ড্রিঙ্কস দেওয়ার দ্বিতীয় পর্ব। এবার পানি নিলাম। খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হলে কেবিন ক্রু-রা এসে প্যাকেট, কাপ, ইত্যাদি আবর্জনা সব টুকে টুকে নিয়ে গেল। 

খাবার পর্ব শেষ হলেও কেবিনের লাইট বন্ধ হলো‌ না। দেখলাম অনেক প্যাসেঞ্জার-ই টয়লেটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। আমাদের পেছনের সিটের একজন লোক বিজনেস ক্লাসের পর্দা ভেদ করে সামনের টয়লেটের দিকে গেল। কিন্তু ওদিকে থাকা গম্ভীর গোছের একজন সিকিউরিটি গার্ড তাকে ফিরিয়ে দিল। বিষয়টি খেয়াল না করেই একটু পর আরেকজন বিজনেস ক্লাসের টয়লেটের দিকে এগুলো। তার পরিণতিও একই হলো। তাকেও ফিরিয়ে দিলো সেই গার্ড। দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিয়ে গার্ড একটি স্টিলের নেমপ্লেট হাতে করে এনে পর্দায় ক্লিপ দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে গেল। নেমপ্লেটে লেখা– বিজনেস/ফার্স্ট ক্লাস। 

আমি তবুও এই "ক্লাস" ধারণাটি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতে চাইলাম। তাই একজন কেবিন ক্রু-কে জিজ্ঞেস করলাম আমি সামনের টয়েলেটে যেতে পারি কিনা। সে বেশ ঘুরিয়ে উত্তর দিলো, 'দেয়ার আর থ্রি টয়লেটস্ ইন দ্যি ব্যাক। বাট দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান ইন দ্যা ফ্রন্ট। ইটস্ বেটার টু ইউজ দ্যি ওয়ান ইন দ্যি ব্যাক।' 

কিন্তু আমাদের সিটগুলো যে সামনের দিকে! পেছনের টয়লেটগুলো অনেক-ই পেছনে। নিজেদের কমিউনিস্ট দাবি করা একটি দেশের রাষ্ট্রীয় বিমানে ক্লাসের ধারণার অপরূপ ব্যবহার দেখে কিছুটা হতাশ-ই হলাম। যাই হোক। মিনিট ত্রিশ পরে কেবিনের লাইটগুলো নিভে গেল। ফের মেলবন্ধন হলো আঁধার ও নীরবতার। 

চীনে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা, বাংলাদেশে তখনো গভীর রাত– প্লেনের জানালায় মাখা কালো রঙ ধীরে ধীরে নীলচে রূপালী রঙ নিতে শুরু করলো। তারপর গাঢ় নীল‌। গাঢ় নীল ফেটে লালচে। লালচে থেকে হলদে। হলদে থেকে হলদে আকাশী হয়ে সম্পূর্ণ আকাশী রঙ নিয়ে সকাল হলো। 

রাত থেকে ভোর হয়ে সকাল হওয়ার এই অভিনব দৃশ্য কেবল চীনের আকাশেই নয়, বাংলাদেশের আকাশেও দেখা যায়। ভোর থেকে সকাল হওয়ার এই সাতরঙা খেলা আমি প্রথম দেখেছিলাম ২০১৪ সালে। সেবছর আগস্ট মাসে বড় চাচার বাসার বাইরে‌ দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আদর ভাইয়াকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে সেই অ্যাম্বুলেন্স। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ভাইয়া। কিন্তু গাড়ি আসতে বড্ড দেরী করছিল দেখে আমি ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং গগনের সেই সাতরঙা খেলা দেখে বিস্মিত হচ্ছিলাম। 

১১ বছর পার হয়ে গেছে। এখনো গগনের এই খেলা আমায় বিস্মিত করে। ভাইয়ার স্মৃতিগুলোকেও জীবন্ত করে তোলে প্রতিটি ভোরের আকাশ। 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 4 months ago

    প্লেন এর মধ্যে আর কি কি অভিজ্ঞতা হয়েছে?