🌙 গল্প: “শেষ চিঠি – তৃতীয় পর্ব: ছায়ার মুখোমুখি”
⸻
দু’বছর কেটে গেছে।
শাওন এখন পরিচিত একজন সাহিত্যিক। তার লেখা “শেষ চিঠি” গল্পটা একে একে বই, নাটক, এমনকি মঞ্চনাট্যেও রূপ নিয়েছে।
মানুষ তার লেখায় খুঁজে পেয়েছে সত্যিকারের কষ্টের ছায়া—যেটা তাদেরও ছুঁয়ে যায়।
মায়া এখন শাওনের জীবনে অদৃশ্য একটা আলো।
তারা একসঙ্গে চা খায়, বই পড়ে, ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু একটা সীমা—যা কেউ অতিক্রম করেনি।
মায়া মাঝে মাঝে বলে,
“তুমি কি এখনো ওকে ভুলতে পারোনি?”
শাওন চুপ করে থাকে। তার চোখে ভেসে ওঠে সেই পুরনো চোখজোড়া—তাসফিয়ার।
⸻
একদিন সন্ধ্যায়, একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজক ফোন করে জানায়—
“আমরা চাচ্ছি, এবার তোমার গল্প ‘শেষ চিঠি’র ওপর একটা লাইভ আলোচনা হোক। তোমার সঙ্গে একজন পাঠকও থাকবে, যাকে গল্পটা গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।”
শাওন সম্মতি দেয়। দিন ঠিক হয়।
অনুষ্ঠানের দিন—
শাওন প্রস্তুত ছিল, কথাবার্তা, আবেগ সব গুছিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু মঞ্চে যে পাঠকটি উপস্থিত হয়, তাকে দেখে শাওনের দম বন্ধ হয়ে আসে।
তাসফিয়া।
হ্যাঁ—তাসফিয়াই।
তিন বছর পর, এই প্রথম তারা মুখোমুখি।
তাসফিয়ার চোখে কাজল, পরনে হালকা শাড়ি, গলায় চেনা সেই নীরবতা।
কিন্তু মুখে সেই পুরনো মায়াবী হাসি।
পুরো অডিটোরিয়াম চুপ।
আলোচক জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি শাওনের গল্পে কী খুঁজে পেয়েছেন?”
তাসফিয়া মাইক হাতে নিয়ে বলল—
“আমি সেই মেয়ে, যার জন্য ‘শেষ চিঠি’ লেখা হয়েছিল।
আমি এটা আজ প্রথমবার বলছি, কারণ এতদিন সাহস পাইনি।
আমি এই গল্পের চরিত্র—কিন্তু আমি এর মতো সাহসী নই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু তা ধরে রাখতে পারিনি।”
অডিয়েন্সে ফিসফিসানি।
তাসফিয়া এগিয়ে এসে শাওনের পাশে দাঁড়াল। বলল,
“শাওন, আমি জানি আমি তোমার জীবনের একটা অন্ধকার অধ্যায়।
তবে আজ আমি ক্ষমা চাইতে আসিনি। আমি এসেছি একটা সত্যি বলার জন্য—
আমি কখনোই সুখী ছিলাম না। তোমার সব চিঠি আমি পড়েছি… সব।
কিন্তু তখন কিছু বলার সাহস ছিল না।
আজ, আমি শুধু চাই… তুমি যদি পারো, আমাকে মাফ করে দিও। না হয়, চিরকাল দোষী রেখো—কিন্তু তোমার গল্পটা আমার সঙ্গেও শেষ হতে দাও।”
⸻
শাওন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তাসফিয়ার চোখে জল…
মায়া সেই পেছন থেকে সব দেখছিল—চোখে জল, কিন্তু মুখে শান্তি।
অনুষ্ঠান শেষে তাসফিয়া শাওনের কাছে আসে। বলে,
“তুমি চাইলে আমি তোমার জীবন থেকে চিরতরে চলে যাবো। শুধু বলো—তুমি কি আজও ভালোবাসো আমাকে?”
শাওন একটু থেমে বলে—
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম… এমনভাবে, যেটা আজও আমার গল্পে রয়ে গেছে।
কিন্তু আমি এখন এমন একজনকে পাশে পেয়েছি, যে আমাকে হারাতে ভয় পায় না।
তুমি আমার অতীত,
মায়া আমার ভবিষ্যৎ।”
তাসফিয়া নিচু মাথায় চলে যায়… শান্তভাবে।
⸻
সেদিন রাতে শাওন তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে—
“ভালোবাসা ফিরে এলেও, জীবন তাকে আগের জায়গায় বসাতে পারে না।
ভালোবাসা যদি ছাড়তে না শিখে, সে কখনোই বাঁচতে পারে না।
আমি আজ সত্যিই মুক্ত।”
সেই রাতে, ছাদের নিচে চা হাতে বসে শাওন মায়াকে বলল—
“আজ আমি তাসফিয়াকে শেষবার দেখলাম।
তবে এবার চিঠি লিখব না।
এবার গল্প শুরু করব—তোমাকে নিয়ে।”
মায়া হাসল। ধীরে ধীরে হাত রাখল শাওনের হাতের ওপর।
আকাশে একটা তারা পড়ল।
⸻
🌸 শেষ কথা:
ভালোবাসা কখনো চলে যায় না।
কিন্তু জীবন শিখিয়ে দেয়—কারা গল্পের পৃষ্ঠা, আর কারা পুরো বই।
শাওন হয়তো তাসফিয়াকে হারিয়েছিল, কিন্তু তার সাহস, সত্যতা আর অপেক্ষা তাকে নিয়ে এসেছিল নতুন আলো—মায়ার কাছে।
এটাই জীবনের সবচেয়ে গভীর উপলব্ধি।
⸻