Posts

উপন্যাস

রুনা লায়লার সুর ও কিংবদন্তি অবলম্বনে গীতি-উপন্যাস "মায়ার সিংহাসন"- ৪

June 26, 2025

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

270
View
অলংকরণ: রাজীব দত্ত

পর্ব- ৪: আফসান কো আনজাম মিলা 

পরেরদিন সকাল শুরু হলো তুলনাহীন উজ্জ্বলতায়। বরেন্দ্র মিউজিয়ামের মূল ফটকে ততক্ষণে রোদ বাতাসের খেলা।  টিকেট কাটলাম খুব সহজে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘরে আজকে আমরা দুইজনই বোধহয় উদ্বোধনী অতিথি। এখনো সবগুলো কক্ষ পুরোপুরি খোলা হয় নাই। একজনকে দেখলাম ঝাড়ু হাতে বারান্দা-ঘর ছুটোছুটি করতে। বাকিরা খুব আয়েশ করে চা খাচ্ছে। বাংলা খবরের কাগজের একেক পৃষ্ঠা একেক জনের হাতে। আর ইংরেজিটা অস্পৃশ্যের মতো একটা বাতিল চেয়ারে পড়ে আছে। 

কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে, আমরা বাম দিকের গ্যালারি থেকে শুরু করলাম যৌথ চোখে ইতিহাস দর্শন।  এখানকার বিষ্ণু-মূর্তির সংগ্রহ বরাবরই অবাক করা। এই নিয়ে অন্তত পাঁচ ছয় বার আসা হলো আমার, কিন্তু দেখে শেষ করতে পারি নাই একবারও। কখনো শেষ না হওয়া আগ্রহ এরপর আমাদের টেনে নিয়ে গেল টানা বারান্দার উত্তর কোণে। সারি সারি করে সেখানে আরো কিছু নতুন সংগ্রহ রাখা। প্রাচীন পাথর গুলোর উপর সকালের আলো ঝলমল করছে। প্রিয় অতিথির চোখে খেয়াল করে দেখলাম গাঢ় কাজল দেয়া। কৌতুহলের আভায় তার মুখে ফুটে আছে অজানা খুশির ফুল। আমাদের কেউ দেখছে না নিশ্চিত হয়ে, মুগ্ধ মনে ওর হাত ধরলাম; আর খোলা চুলের সুগন্ধি ছায়া এসে আমার গায়ের উপর গড়িয়ে পড়লো। পাবলিক প্লেসে দিনের বেলা এমন দুঃসাহস আমার আগে কখনও হয় নাই। ওর হাতও হালকা কাঁপছে দেখলাম। ইতিহাস ঐতিহ্য ছাপিয়ে জাদুঘরের বারান্দায় হঠাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের উদ্বায়ী বর্তমানটুকু। সুন্দর সময়গুলো ভয়ডর ভুলে উপভোগ করাই জানি ভালো। কিন্তু আমি সচরাচর পারি না। যেকোনো  সুখের পরম অনুভবকে এক নিঃশ্বাসে উড়িয়ে দিয়ে  সামনে ভেসে ওঠে একলা কাটানোর ভবিষ্যতগুলো।  আজকেও আমাদের প্রেমকাহিনীর উপসংহার দেখছি যেন সম্পর্কের শুরুতে বসেই। বারান্দা থেকে আবার গ্যালারিতে যেতে যেতে আমার প্রেমিকা কী গান গুন গুন করে গাইছে ঠিক ধরতে পারলাম না। তাই ওর আবছা সুরে আমি বসাতে লাগলাম বারবার শোনা পছন্দের এক উর্দু গানের বাণী। বিরহকাতর সুর বসানো অবুঝ প্রেমের কবিতা যেন।

জিন্দেগি ডুব গায়ি উনকি হাসিঁ আঁখোমে

ইউ মেরি পেয়ার কে আফসান কো আনজাম মিলা

উনকি নাজরোসে মোহাব্বাত কা জো প্যায়গাম মিলা

জাদুঘর থেকে গেলাম টি বাঁধ। পদ্মার শুকনা বুক নিয়ে একসাথে হা হুতাশ করলাম কিছুক্ষণ। এরপর পুরো বিকেল কাটলো ইউনিভার্সিটিতে। কাজলা গেইটে দেখা হয়ে গেলো সেই রিপোর্টারের সঙ্গে। তাঁর মেয়ে শুনলাম ক্যাম্পাসের স্কুলে পড়ে।  বিব্রতকর পুলিশি রাতের পর, তার সাথে আমি কখনো দেখা করি নাই। থানা থেকে ফেরার পর একবার মাত্র ফোনে কথা হয়েছিল, মাত্র দুই তিন বাক্যে। অতি প্রিয় অতিথির সামনে, ভাগ্য ভালো, রিপোর্টার সাহেব পুলিশ হাজত জামিন বিষয়ে কিছু বললেন না। সন্ধ্যায় দুইজনকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তিনি দ্রুত রিকশায় উঠে বসলেন। 

এই লোকের মেয়ে স্কুলে পড়ে? সিরিয়াসলি! উনার বয়স তো কম করে হলেও সত্তর। 

আমার প্রেমিকার অনুমান ভুল না‌‌। সেই ষাইটের দশক থেকে দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেন এই লোক। চুল সব ধবধবে সাদা। তবে তাঁর একমাত্র মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে এটাও সত্য‌‌। মেয়ের জন্মের সময় তার বয়স পঞ্চাশের ঘরে‌। বিয়ে করেছিলেন তার মাত্র বছর সাতেক আগে। স্ত্রীর সাথে তার বয়সের পার্থক্যও ছিল কম করে হলেও একুশ বছর।

চলো স্টেশনের দিকে যাই। আই মিন ইউনিভার্সিটির স্টেশন। এখন আর ট্রেন থামেনা যদিও। বলতে পারো পরিত্যাক্ত। পাশের একটা দোকানে এমন ভালো মুরগির মাংস রান্ধে!

আমার সব প্রস্তাবেই এই মেয়ে দ্বিধাহীন রাজি হয়ে যাচ্ছে। অথচ ফোনে কথা বলার সময় আমার মনে হতো অন্যরকম। বেশিরভাগ বিষয়েই ‘না’ বলা। আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতের স্মৃতির সাথেও ওর আজকের উচ্ছলতা মিলাতে পারছি না। 

কয়েক সপ্তাহ আগে, বৃহস্পতিবার বিকেলে আমি কলেজ থেকে ফিরে ঘুমিয়ে গেছি। কিছু দিন হলো ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হচ্ছে। তাই বিকেল হলেই আর চোখ খুলে রাখতে পারি না ইদানিং। আমাদের হোস্টেলের পাশের একমাত্র ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে একটা বারো তেরো বছরের ছেলে বসে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। খুবই ভদ্র ছেলে কিন্তু কোনো কথা আস্তে বলতে পারে না। গলার স্বর ভাঙতে শুরু করেছে কিন্তু তীক্ষ্মতা কমে নাই এক বিন্দু। ঐ ছেলের তীব্র চিৎকারে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। কোনমতে অর্ধেক চোখ খুলে টলতে টলতে  বারান্দায় গিয়ে দেখি গ্রিল ধরে ঝুলে আছে। কানে কালো মোবাইল ফোনটা।

কী হলো ভাই? এমুন মরার মুতন কেউ ঘুমায় নাকি এ সুমায়! আপনাক ভাবি কল কচ্ছে সেই তিনড্যা থ্যাক্যা। ধরেন, কথা বুলেন।

ভাবি কে? কোন ভাবি? 

আমার ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বিরক্তি আর বিস্ময়। গ্রিলের ভেতর থেকেই ফোনটা নিলাম। “হ্যালো” শুনতেই মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। ঘুম বিরক্তি সব উধাও হয়ে কেবল বিস্ময়ের রেশ টিকে আছে। 

আপনি যাকে ভাবতেছেন আমি সে না। তার ছোট বোন। বহু কষ্টে এই ফোন নম্বর জোগাড় করছি। 

দুই বোনের কণ্ঠস্বরে আসলেই অনেক মিল। অবশ্য পার্থক্য বুঝতেও‌‌ খুব বেশি দেরি হলোনা। বড়বোনের প্রমিত শব্দগুলোর উচ্চারণ আরো একটু স্পষ্ট। 

কী ব্যাপার? সরি আমি আসলে একটু কনফিউজড। কোনো খারাপ কিছু না তো?

সব কথা ফোনে বলা মুশকিল, ভাইয়া। আপনি একবার যদি কষ্ট করে আমাদের এলাকায় আসতেন। কালকে তো শুক্রবার আছে। ভোরে বাসে উঠে যান, প্লিজ।

তেমন কিছুই আর বললো না। তবে বলার ধরণে উদ্বেগ বোঝা যাচ্ছিল। বিস্তারিত ঠিকানা দিয়ে সে ফোন রেখে দিলে, আমার মাথায় দুইটা পরস্পর বিরোধী মতামত ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। এই রকম রহস্যময় উদ্বিগ্ন দাওয়াত উপেক্ষা করা অসম্ভব। আবার চেনা জানা নাই এমন একটা মফস্বল এলাকায় একা একা চলে যাওয়াও মনে হচ্ছে নিরাপদ না। কতো কিছুই তো ঘটতে পারে। সারারাত কেটে গেলো মোটামুটি নিদ্রাহীন। যাওয়া না যাওয়ার ভালো মন্দ, আনন্দ বিপদ ভাবতে ভাবতে ফজরের আজান দিলো। জানলা বন্ধ করে আচমকা আমি যন্ত্রের মতো ব্যাকপ্যাক গুছানো শুরু করলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে দেখি জানলা-খোলা বাসে বসা।

পৌঁছাতে সব মিলিয়ে ঘন্টা তিনেক লাগলো। পথ আরো কম কিন্তু লোকাল বাস। কোনো জায়গায় থামলে আর সহজে আগায় না। আমার এইদিকে খালিপেট। ব্যাগে শুধু পানির বোতল ছিল। ওদের শহরে ঢুকতেই বাস টার্মিনাল। সেখানে চা সিঙাড়া ছাড়া আর কিছু পেলাম না। একেতো ঘুম হয় নাই সারারাত, তার উপর অভুক্ত। বিশ মিনিটের পথ যেতে আমার প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগলো। কাগজে লেখা ঠিকানার সাথে মিলিয়ে  ওদের দোকানটা খুঁজে পেতে আরো মিনিট দশেক। 

খুবই ছোট্ট একটা ঘর মাঝখানে টিনের পার্টিশন দিয়ে দুই ভাগ করা। একপাশে পান সিগারেট আর ফোন ফ্যাক্স। আরেকদিকের অংশ একেবারেই অন্য রকম। ঘরটায় একটা চৌকি, সামনে কিছু মোড়া বসানো। পেছনে কাঠের আলমারি। ভেতরে কী আছে বোঝার উপায় নাই। কী বিক্রি হয় কাউকে জিজ্ঞেস না করে জানা অসম্ভব।  

চলবে…
 

Comments

    Please login to post comment. Login