পোস্টস

চিন্তা

স্মৃতি কথা

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

তাসলিহা মওলা

মূল লেখক তাসলিহা মওলা

ছোটবেলায় গ্রামে যেতাম রেলগাড়িতে চড়ে। রেলগাড়িগুলোর নামও ছিল কত সুন্দর। ঊর্মি অরুনা, ঊর্মি গোধুলী, উপকূল এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশীথা। ঊর্মি অরুণা ছাড়ত ভোরে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উঠতাম ট্রেনে। আমি বরাবর জানালার ধারে বসতাম। এখনো যেকোন বাহনে আমি জানালার পাশে বসি। প্লেনের সিটও জানালার পাশে হলে আমি খুশী। যাই হোক। সেই ট্রেন কত মাঠ ঘাট গ্রাম প্রান্তর ছাড়িয়ে ছুটে যেত। প্রতিবার ভৈরব ব্রিজে ট্রেন উঠার পর আমার ভয় লাগত। আর আব্বু প্রতিবার একই ভাবে বলত "এই ভৈরব ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ"। ট্রেন আখাউড়া পার হবার সময় পাশে টিলা পড়ত। আব্বু প্রতিবার একইভাবে হাত নেড়ে নেড়্র আমাদের বলত " পাহাড়ের ওইপাশে ইন্ডিয়া, পাহাড়ের,  ওইপাশে ইন্ডিয়া, পাহাড়ের ওইপাশে ইন্ডিয়া"। আমার  শিশুমনে তখন শিহরণ খেলে যেত "ইন্ডিয়া এত কাছে"! 
ট্রেন লাকসাম জংসনে পৌছালে আমি বুঝে যেতাম আর কিছুক্ষণ পরেই ফেনী। লাকসামে ট্রেন থামত কিছুক্ষণ।  যাত্রীরা উঠত নামত। মাঝে সাঝে ট্রেনে আব্বু আম্মুর পরিচিত মানুষও পাওয়া যেত। কেউ হয়ত আব্বুর কলিগ আবার কেউ বা আম্মুর গ্রামের বাড়ি মীররশ্বরাই এর আত্মীয়। আমরা আবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার তাঁদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতাম।
ঊর্মি অরুণা ফেনী পৌছাত তিনটা সাড়ে তিনটায়। আর ঊর্মি গোধুলী ছাড়ত বিকেল তিনটায় সেই ট্রেন রাত ন'টা কি সাড়ে ন'টায় ফেনী পৌঁছাত। তখন নব্বইয়ের দশক। ফেনী এক ত্রাসের শহর। অত রাতে বেবী ট্যাক্সি বা টেম্পো করে সোনাগাজী যাওয়া মানে ডাকাতের হাতে প্রাণ দেয়া। তাই আমরা মায়ের বান্ধবী শিরিন খালার বাড়িতে থেকে যেতাম রাতে। শিরিন খালার স্বামী ফকরুল খালু ছিলেন ইউএনও। বিরাট বাড়ি। কত যে ফুল গাছ ছিল সেই বাড়িতে। পরদিন সকালে আমরা অস্থির হয়ে থাকতাম কখন যাব গ্রামের বাড়ি। খালুর পিওন বেবী ট্যাক্সি নিয়ে এলে আমরা বাক্স পেঁটড়া সমেত চড়ে বসতাম। ফেনী ট্রাংক রোড ধরে স্টেশন পেছনে ফেলে শহর ছাড়িয়ে বেবী ট্যাক্সি ভটভট আওয়াজ তুলে চলত সোনাগাজীর দিকে। সেসময় রাস্তা ছিল একটু পর পর ইটের সোলিং করা। মাঝে মাঝেই খানা খন্দ গর্ত। ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা হাসতাম দুই ভাইবোন। গ্রামের পর গ্রাম পেড়িয়ে আমরা যাচ্ছি আমাদের সোনাপুর গ্রামে। যেতে যেতে জোড়া তালগাছ ওয়ালা এক বাড়ি দেখলে বুঝতাম বালিয়া চৌমুহনী এসে গেছি। আর ওই জোড়া তালগাছ ওয়ালা বাড়িটা আমার বড় ফুপুর বাড়ি। আরো কিছুদূর সামনে গিয়ে পেতাম বক্তারমুনশী কলেজ। আব্বু প্রতিবার আমাদের বলত "এইখানে তোমার নানার প্রথম পোস্টিং ছিল"। নানা বক্তার মুনশীর সার্কেল অফিসার ছিলেন সেই বৃটিশ আমলে। আরো কিছুদূর সামনে গিয়ে মতিগঞ্জ। মতিগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে আব্বু সবসময় বলত " এ পথে আমি যে গেছি বার বার"। মতিগঞ্জ হাইস্কুল থেকেই আমার বাবা ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। সে পথ পার হবার সময় প্রতিবার ওপরের লাইন কটা আউড়াতেন। এতগুলো বছরেও তার বাত্যয় হয়নি।  মতিগঞ্জ পেরিয়ে আরেকটু সামনে গেলে ভৈরব চৌধুরী,  তারপরে সাহাপুর, তারপর মুহুরী নদীর তীরে আমাদের চর সোনাপুর গ্রাম। 
বড় রাস্তা থেকেই দেখা যেত আমাদের মসজিদ। রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে স্কুটার নেমে যেত। তখন রাস্তা কাঁচা ছিল। একেবারে পাঁড়াগেঁয়ে মেঠোপথ যাকে বলে৷ হাতের ডানে বড় দীঘি আর বামে মসজিদ রেখে স্কুটার গিয়ে ঢুকত সোজা একেবারে আমাদের বাড়ি সামনে। স্কুটারের পেছনে বাড়ির ছেলেমেয়েরা যারা কিনা ছিল আমাদেরই সমবয়সী তারা হৈ হৈ করতে করতে ছুটত। ঘরের সামনে দেখতাম রোয়াকের ওপর আমার শ্বেত শুভ্র বসনা দাদী দাঁড়িয়ে আছেন। আশেপাশের সবাই একে একে আসত আমাদের দেখতে। বিশাল বাড়ি। অগুনতি মানুষ, কিলবিল করত ছেলেপুলে। আম্মু ঢাকা থেকে কমলা নিয়ে যেত। গ্রামে তখন আপেল, কমলা এসব ছিল বিষ্ময়কর জিনিস৷ আমি এখনো ভাবি কত কমলা আব্বু আম্মু নিত যে সেই বিস্ফোরিত জনসংখ্যার  সবাই কমলা পেত! আসলে কমলা ছিলে প্লেটে করে সাজিয়ে দেয়া হত। আর এখন সেই বাড়ি একেবারে খাঁ খাঁ করছে। রাস্তা পাকা হয়েছে, পাকা হয়েছে সবার ঘর। সেই কাঁচা মসজিদ আর কাছারি ঘর এখন ঝাঁ চকচকে আলিশান রূপ নিয়েছে। কিন্তু আমি আজো সেই সহজ সরল, মেঠো পথের, মেটে উঠানের সেই মিঞা বাড়িকেই ভালবাসি। চোখ বন্ধ করলেই আজো সেই সময়টা অনুভব করতে পারি। সেই সন্ধ্যে সাতটায় খাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘুমুতে যাওয়া। রাত আটটা নটা মানে তখন গভীর রাত। হারিকেনের টিমটিমে আলো, ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন গান, রাত গভীরে শেয়ালের ডাক, বেড়ার ফাঁক দিয়ে হিম শীতল বাতাসের ঘরে ঢোকা, আম্মুর সেই শাড়ি, বিছানার চাদর বেড়ায় ঝুলিয়ে হিম আটকানো, শীতের হাওয়ায় পলকা দরজার হঠাৎ নড়ে ওঠা, শিয়ালের ডাক, সেই নরম ভোর, কুয়াশায় ভিজে যাওয়া পা, সেই মসজিদের পুকুরের টলটলে জলে বাবার হাপুস হুপুস ডুব, পুকুর ঘাটে ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই আমি, সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো সেইসব দিনগুলো। 
জীবন কত ভাবেইনা রূপ বদল করে, বাঁক বদলায়, স্রোয়ে গা ভাসায়। কিন্তু মধুর স্মৃতি দিনে দিনে মধুরতর হয়।
মন গেয়ে ওঠে
 "মধুর তোমার শেষ যে না পাই
প্রহর  হল শেষ,
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ আবেশ"।