কালো হোক, কিংবা গাঢ় ধূসর -কোনো রঙেই ঢেকে রাখা যায় না বীর রফিকুল ইসলামদের প্রজ্ঞা, প্রেম ও প্রস্তাবনার জ্যোতি। যারা মায়ের ভাষায় কথা বলে, তারা কি চুপ করে থাকবে ভাষাসৈনিকের মুখমণ্ডল মুছে ফেললে?
গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের স্মরণে কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে নির্মিত ম্যুরালটি ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। ১৯৯৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রফিক তার সহযোদ্ধা আবদুস সালামকে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি সংগঠন দাঁড় করান এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থনের প্রচেষ্টা শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। এ গৌরবময় অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাদের সংগঠন একুশে পদক লাভ করে।
আজ আবারো প্রমাণ হলো -বায়ান্ন ও একাত্তরের চেতনার শরীরে মরচে ধরাতে চায় কিছু অসভ্য, কূপমন্ডুক, ইতিহাসভ্রষ্ট ও জাতি-অস্বীকারকারী অপশক্তি। যারা ম্যুরাল ভাঙে, তারা আসলে মুখোশ খুলে ফেলে নিজেদের আসল জাত চেনায়। কারণ রফিকুল ইসলাম শুধু একটি নাম নন -তিনি আমাদের জাতিসত্তার আন্তর্জাতিক উচ্চারণ, ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে আনার এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার স্মরণে নির্মিত ম্যুরাল ভাঙা মানে নিজের শিকড় ছিঁড়ে ফেলার মতো আত্মহননের সমান।
এ ঘটনাকে নিছক ভাঙচুর ভাবলে ভুল হবে। এটি প্রতীকী মব সন্ত্রাস -স্মৃতির ওপর আঘাত, চেতনার ওপর থাবা, ইতিহাসের ওপর নিঃশব্দ ঘোষণা -"আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ছি, যেখানে ইতিহাসের মূল স্তম্ভগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হবে!"
কিন্তু মনে রাখা দরকার -এদেশে যতবার ভাষার ওপর হাত উঠেছে, স্বাধীনতার ওপর আঘাত এসেছে; ততবারই সেই অশুভ তৎপরতা পুড়ে ছাই হয়েছে মুক্তিকামী জনগণের প্রতিরোধে। বায়ান্ন আর একাত্তরকে বাদ দিয়ে আপনারা যে “নতুন বাংলাদেশ” বানাতে চান, সেটি আসলে এক ছিন্নমূল রাষ্ট্রের ছায়াচিত্র মাত্র। আমরা সে রাষ্ট্র চাই না।
আমরা চাই, সেই চিরায়ত বাংলাদেশ -যার নির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধারা, ভাষাশহীদরা, রফিকুল ইসলামরা।
আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এই অমানবিক ও অবমাননাকর ঘটনার। আমরা বীরের ম্যুরাল পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানাই, তবে কেবল ইট-পাথরের নয় -চেতনাতেও, পাঠ্যপুস্তকে, প্রশাসনে, আমাদের সন্তানদের মননে।
এদেশ বীরদের, কাপুরুষদের নয়।
বীরেরা গর্বের ইতিহাস লেখেন, আর কাপুরুষেরা ভেঙে চুরমার করে সভ্যতার সুন্দর দেয়াল। ইতিহাস তার গৌরবের প্রাচীরকে নিজেই রক্ষা করবে।
ফারদিন ফেরদৌস
২৭ জুন ২০২৫