ত্রিকালরাগ
নিশিথ নিসর্গে চন্দ্রাবালার চোখে জ্বলে বনের নিভৃত দহন, ছায়াবৃত প্রহর গণনা করে—ধূসর ব্যঞ্জন কুয়াশার কাব্যরেখা।
বিষাদ-রেণুর অভিসারে ঝরে পড়ে বকুলফুলের ম্লান অনুরণন, নিবিড় ব্যাকরণে শব্দেরা ফিরে আসে পলাতক মৌনতায়।
জোছনার গায়ে লেখা পুরাতন ব্যথার স্তবক,
হিমেল বায়ুর আদরে শাপলা-পত্রে জমে ওঠে অতীতের জলছবি। জীবনের অভিধানে সংযোজিত এক নতুন ‘অকারণ’, যেখানে ভালোবাসা মানে—পালিয়ে যাওয়া কিছু পলক অথবা বহতা নদীর গোপন প্রতিস্রোত।
ডাহুকের ডাকে জেগে ওঠে স্মৃতির পালঙ্ক,
আর আমি— বিপন্ন ঋতুচক্রে বসন্ত ও বিষাদের সমবেত গীতিকার। তুমি ছিলে অলীক এক জলছায়া, হেমন্তের সোনালি দুর্বিপাকে তবুও চঞ্চল পাতার মতো তোমার ছায়া রেখে গেলে শিরায় শিরায়।
আধোঘুমে শুয়ে থাকা আকাশের গা বেয়ে নামে জেগে ওঠা আকাশবর্ণী আকুতি—তারই ঢেউয়ে জীবনের নিরন্তর ব্যাকরণে; লিখে ফেলি আমি—প্রেম, প্রকৃতি, পরাজয়; এ এক অপরূপ ত্রিমাত্রিক ভাষ্য।
ছাই ও ছায়াপাত
আকাশপটের ধূসর রেখায়—উঠে আসে ভাষাহীন এক অভিধান, যেখানে প্রতিটি ব্যঞ্জনা দগ্ধ হয়েছে সভ্যতার নির্বিকার শাসনে; মূল শব্দ পুড়ে গিয়েছে যজ্ঞে, থেকে গেছে ছাই, আর ছাইও তুচ্ছ নয়—
তাতে লেগে আছে উচ্চারণহীন কোন এক কালপরম্পরার ছায়াপাত।
চিহ্নহীন এক অবয়ব খোঁজে স্ফুলিঙ্গের ঠাঁই, শরীর নেই, নাম নেই, তবু শিরায় প্রবাহিত হয় এক প্রাগৈতিহাসিক সঙ্কেত—যা রন্ধ্রে রন্ধ্রে জন্ম দেয় বিপ্লবের পূর্বভাষ্য। প্রেম এখানে নিক্ষিপ্ত এক ছায়া, অবচেতনের সিঁড়ি বেয়ে নামা গহ্বরে
যেখানে জল নয়, রয়ে গেছে দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি— মুগ্ধ নয়, ম্রিয়মাণ নয় বরং অপার স্পর্শের অতল আত্মসংবরণ।
অভিজ্ঞতার অভিধান
নিশ্চল বেদনায় রক্তিম নীরবতা, অভ্যন্তরের শূন্য গহ্বরে প্রজ্জ্বলিত অনুজ্জ্বল আকুতি—চেতনায় চুইয়ে পড়ে উষ্ণতর এক প্রাগৈতিহাসিক অনুতাপ, কবজির শিরায় দহনে ডুবে থাকা একটানা নিবিড় বিকেল। দাহের উৎসব শুরু কেরোসিনে, সাবধানে ছেঁড়া কাঠি ঘষে উঠে আসে অদৃশ্য আগুন, যেখানে ছাই হয়ে যায় অনুচ্চারিত আবেগ, বাষ্পে মিশে যায় শব্দহীন এক ব্যাখ্যাতীত আত্মদহন।
সুখের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, অস্ফুট আহ্বানে ডুব দেওয়া —নির্দিষ্ট কোনো প্রাপ্তির নয় বরং প্রতিনিয়ত অন্বেষণে বেঁধে ফেলা সম্ভাবনার নোঙর। বিষণ্নতার ব্যুহ পেরিয়ে পালিত হোক হৃদয়ের নিষ্কলুষ কৃষিকর্ম, যেখানে দুর্বোধ আকাঙ্ক্ষা ভেঙে গড়ে মগ্নতা এবং সংযত অনুরাগে জেগে থাকে অনিবার্যতা। প্রেম এখানে উপচায় নয় বরং চুঁইয়ে পড়ে স্নায়ুর অতল থেকে, প্রতিরোধহীন বিকারের মতো। যাপনকে ঝাঁকিয়ে তুলে, আদিম কোনো উদ্ভ্রান্তির ভিতর থেকে উঠে আসে আকুলতা।
অতএব বাঁচা মানে পালিয়ে যাওয়া নয় বরং গভীরভাবে ডুবে থাকা, অতল এক অভিজ্ঞতায়, যেখানে ভালোবাসা নিজেই হয়ে ওঠে ভাষাহীন এক অভিধান।