
আহা! রথের মেলা
আহমেদ সাব্বির
ছোটবেলায় আমরা রথের মেলায় যেতাম ভাই-বোনেরা দলবেঁধে। চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোনে ভর্তি ছিল আমাদের ডাক্তার বাড়ি।
আষাঢ় মাস। অবিরাম বর্ষণে আমাদের গোলপাতার আটচালা ফুলে-ফেঁপে উঠত। স্যাঁতসেতে ঘর। চুন-সুরকির ভেজা দেয়াল। উঠোনে থিকথিকে কাদা। চারপাশ থেকে ভেসে আসত আম-কাঁঠালের গন্ধ।
বর্ষায় বহেরা গ্রাম চোখ ধাঁধানো সুবজে ঢেকে যেত। গাঢ় সবুজতায় লতিয়ে থাকত চারপাশ। আকাশ বিষন্ন। পুকুর-ডোবায় থৈ-থৈ পানি। গ্রামের পাশ্চিমে লাবন্যবতী খাল। সেই খালে বড়বড় বোয়াল আর টেংরার স্রোত। শত শত ছিপ-বড়শিতে ভরে যেত খাল। মায়েরা-চাচীরা আমদের চোখে চোখে রাখত সারাক্ষণ। আমরা যাতে একা একা খালে বা পুকুরঘাটে না যাই। বর্ষায় আমরা ভাই-বোনেরা অপেক্ষা করতাম কবে রথের মেলা বসবে।
তখন ফোন ফেসবুক ছিল না। থ্রি-ব্রান্ডের রেডিওর যুগ। টেলিভিশন ছিল দুর্লভ, অভিজাত। বড়দের কানাঘুঁষায় আমরা জানতে পারতাম আজ রথযাত্রা। রথের আনন্দে আমাদের মেঘলা দুপুর রৌদ্রজ্জল হয়ে উঠত। উত্তেজনায় ঘুমুতে পারতাম না। অবুঝ বুকে তোলপাড় খেলা শুরু হয়ে যেত।
রথের দিন দাদী ভাত খেতে খেতে বলতেন- ‘তাড়তাড়ি ঘুমিয়ে নে। বিকেল সমছেল রথের মেলায় নিয়ে যাবে। সমছেল (সামসুল) ভাই আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার। সম্পর্কে চাচা হলেও আমরা ভাই বলে ডাকতাম। বিকালে দাদী আঁচলের খুঁট খুলে টাকা বের করতেন। সব ভাই-বোনকে পাঁচ টাকা করে দিতেন। বলতেন- ‘খাবার খাবি, খেলনা কিনবি। সমছেলের হাত ছাড়বি না।’ আমি দাদীর কাছ থেকে পাঁচ টাকা পেতাম। আর দাদীর কাঠের শেলফে একটা কাচের জগে টাকা আর ওষুধ থাকত। সেখান থেকে চার-পাঁচ টাকা গোপনে তুলে নিতাম। সমছেল ভাইয়ের কড়া পাহারায় শুরু হত আমাদের রথযাত্রা।
বার্ষার কাদামাখা উঠোন, পিচ্ছিল প্যাচপেঁচে রাস্তা মাড়িয়ে দলবেঁধে আমার যেতাম কুলিয়া ব্রিজে। ব্রিজের পূব পাশে বসত রথের মেলা। সেখানে গরম গরম পাঁপড়ভাজা, জিলাপি, দানাদার, আর গুড়ের মুড়কি পাওয়া যেত। খাবারের খুশবুতে মধুময় হয়ে উঠত মেলা। পাশে দাঁড়ালেই জিভে পানি টলমল করত। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতাম খেলনার পসরা। মাটির ঘোড়া, ব্যাঙগাড়ি, ট্রাক, রবিঠাকুর, বউপুতুল আরো কত কি! রবি ঠাকুরের থুঁতুনিতে তুলোর নরম দাড়ি। হাতে নিলেই মাথা কাঁপাত। মাটির রঙিন হাঁড়িকুড়িও পাওয়া যেত মেলায়। আমি খেলনা শুঁকে শুঁকে দেখতাম। গাঢ় রঙের গন্ধে মন ভরে যেত।
রথযাত্রা শেষে মেলায় ভিড় উপচে পড়ত। সন্ধ্যেবেলা কোঁচড় ভর্তি খাবার আর থলে ভর্তি খেলনা নিয়ে আমারা বাড়ি ফিরতাম। সাথে সমছেল ভাই। আমাদের মনরথে তখন তুমুল উত্তেজনা। কার খেলনা কতটা ভাল, গাড়ির চাকা ত্যাড়া-ব্যাঁকা কিনা, এসব নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা।
রথের মেলার পরদিন ভোরবেলাটা হতো ঘোরলাগা স্বপ্নের মতো। আমরা তড়িঘড়ি করে উঠে পড়তাম। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়েই খেলনা নিয়ে বসে যেতাম। এক সময় বৃষ্টি কমে যেত। আষাঢ়ের আকাশে ঝকঝরে রোদ, রথের মেলার মতোই দুর্লভ হয়ে উঁকি দিত। আমি, সুমি আপা, রুমি, মুন্না, সাথী, রিন্টুভাই ,হাসাভাই দহলিজখানার সামনে শিউলি তলায় জড়ো হতাম। সবার হাতে মাটির খেলনা। কারো বউপুতুল, কারো রবিঠাকুর, কারো গাড়ি। মুন্নার ব্যাঙগাড়ির চাকা আমার ট্রাকের ধাক্কায় প্রায়ই ভেঙে যেত। ভাঙা চাকা নিয়ে প্রথমে ধাক্কাধাক্কি, এরপরে দাদার কাছে গিয়ে বিচার দেওয়া। দুই পক্ষের নালিশ শুনে দাদা দুই টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন- ‘যা খাবার খাগে। রোগী দেখছি। বিরক্ত করিস নে।’ আমরা টাকাটা নিয়ে গুলিমেঠাই আর নাগিনতারা বিস্কুট কিনতে ছুটতাম মোস্তফা খলিফার দোকানে।
ব্যাঙগাড়ির চাকা ভেঙে গেলেই আমাদের রথের মেলা ফুরয়ে যেত।