মানুষ এক সময় ছিলো হৃদয়বান, বিবেকবান, আত্মমর্যাদাশীল এক সত্তা। ভালো-মন্দের বোধ তার হৃদয়ে ছিলো, মুখে যা বলত অন্তরেও তাই থাকত। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ – এসব ছিল মানুষের চেনা পরিচয়। অথচ আজ, সেই মানুষই ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে এক মুখোশধারী প্রাণীতে। বাহ্যিক রূপে সে সভ্য, শালীন, সৌম্য – কিন্তু অন্তরে সে একেকজন নকল অনুভবের, জাল ভালবাসার, ভন্ড আবেগের প্রতিমূর্তি। মানুষ আজ নিজের মুখ লুকিয়ে চলে, কারণ সে জানে তার মুখ আর স্বচ্ছ নয়। সমাজে, অফিসে, বন্ধুত্বে, প্রেমে, রাজনীতিতে এমনকি পরিবারেও এই মুখোশের ছায়া পড়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা সেই মুখোশধারী জীবনের ভেতরের চিত্রগুলো তুলে ধরব, বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দেখাব—কীভাবে মানুষ সত্যিকারের প্রাণী না হয়ে শুধুই এক অভিনয়কারী চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
আজকের সমাজে আপনি যাকেই দেখেন—সবাই যেন নিখুঁত এক অভিনয়ের শিল্পী। কেউ কারো সামনে মিষ্টি কথা বলে, হাসিমুখে কথা বলে, কিন্তু পেছনে ছুরি মারে। আপন ভাই, প্রতিবেশী, অফিস সহকর্মী বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু—কেউই আর পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সম্পর্কগুলো যেন এখন পারস্পরিক স্বার্থের সেতুতে দাঁড়িয়ে, যেখানে একটুও ফাঁক পেলেই তা ভেঙে পড়ে।
বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। রাজীব নামের এক তরুণ প্রকৌশলী তার সহকর্মী হাসানকে মনে করত পরম বন্ধু। হাসান সবসময় তার কাজের প্রশংসা করত, তাকে সহায়তা করার ভান করত। অথচ বাস্তবতা ছিল উল্টো। অফিস বসের কানে নিয়মিত রাজীবের বিরুদ্ধে নালিশ করত সে। একদিন রাজীব যখন চাকরি হারায়, হাসান ছুটে আসে সান্ত্বনা দিতে, যেন কিছুই জানে না! অথচ সেদিন রাজীব বুঝে যায়—এক মুখোশধারী প্রাণীই এতদিন তাকে বন্ধুত্বের ছায়ায় রেখেছিল।
এমন ছলনা শুধু অফিসে বা বন্ধুদের মাঝে নয়, পরিবারেও রয়েছে। মায়ের সামনে সন্তানের যত আবেগ, আদর, যত্ন—তবু সে-ই সন্তান দিনের পর দিন বৃদ্ধাশ্রমে মাকে ফেলে রাখে। স্ত্রী স্বামীর প্রতি প্রেম দেখায়, অথচ স্বার্থসিদ্ধির পর ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য সম্পর্কে। আর সন্তানদের মধ্যে দেখা যায় ভণ্ড আবেগের বৃষ্টি, যেটা কেবল সম্পত্তির হিসাবমাফিক ভালোবাসা।
আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এক মুখোশ পরার জায়গা হয়ে উঠেছে। সেখানে সবাই মহৎ, সৎ, সুশীল—কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবন যেন অন্ধকার এক গুহা। কেউ পোস্ট করে মানবিক কথাবার্তা, অথচ একই মানুষটিই বাসায় কাজের লোককে অপমান করে, দারিদ্র্যকে ঘৃণা করে, প্রতিবেশীর অসুবিধা উপেক্ষা করে। একটা ছবি, একটা স্ট্যাটাস দিয়ে যে সমাজের শ্রদ্ধা অর্জন করা যায়, তা জানার পর থেকে অনেকেই মানুষ না হয়ে প্রোফাইল হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো, এখন মানুষ ধর্ম পর্যন্ত মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। নামাজ পড়ে, কোরআন পাঠ করে বা পূজা দেয়, কিন্তু তার জীবনজুড়ে ছড়িয়ে থাকে অন্যায়, দুর্নীতি ও চাতুর্যের ছাপ। সে ধর্মকে ব্যবহার করে লোক দেখানোর জন্য, ব্যবসার সুবিধার জন্য, রাজনীতির মোড়কে নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এ যেন ধর্মের ছদ্মবেশে কাপুরুষতা।
রাজনীতির মুখোশ আরও ভয়ংকর। নির্বাচনের সময় প্রার্থী আসে দরিদ্রের ঘরে, কান্না দেখে, শিশু কোলে নেয়, বলে—"আপনার জন্যই তো সব করছি।" অথচ ক্ষমতায় বসার পর ভুলে যায় সেই বাড়ির পথ, ভুলে যায় প্রতিশ্রুতির কথা, ভুলে যায় তাদের কান্না। একজন মানুষ যখন ভোটের আগে দরিদ্রের সঙ্গে ভাত খায়, আর পরে পাঁচ তারা হোটেলে প্রাসাদ গড়ে—তখন বুঝতে বাকি থাকে না, সে মানুষ নয়, এক মুখোশধারী শক্তি।
প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট। একজন বলে, "তোমার জন্য জীবন দিতে পারি", অথচ সুবিধামতো সুযোগ পেলে সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়, বা পেছনে দুঃখের পাহাড় রেখে চলে যায়। এই ভালোবাসাগুলো এখন আর হৃদয়ের নয়, বরং দর কষাকষির মতো এক বাণিজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ তার মনের মানুষকে ভালোবাসে না—সে ভালোবাসে তার গাড়ি, পদ, টাকা অথবা সামাজিক মর্যাদা। হৃদয় এখন একটা বস্তাপচা শব্দ মাত্র।
শিক্ষাক্ষেত্রও এর বাইরে নয়। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের বলে, "সৎ হও, অন্যায়ের প্রতিবাদ করো", অথচ তার নিজের জীবন গড়া অন্যায়, ভণ্ডামি আর সুবিধাবাদের চিত্র দিয়ে। কোনো ছাত্র যদি টিউশন না পড়ে, নম্বর কেটে দেওয়া হয়। একজন ছোট্ট শিক্ষার্থী তখন দেখে—যে আদর্শ শেখানো হচ্ছে, তার বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। এই বিভ্রান্তি থেকেই গড়ে ওঠে আরেকটি মুখোশধারী প্রজন্ম।
বিচারের কথা বললে দেখা যাবে, আইনের ছায়াতলেও মুখোশ পড়ে আছে। একজন প্রভাবশালী অপরাধী টাকার জোরে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বের হয়ে যায়, আর একজন নিরপরাধ মানুষ বছরের পর বছর হাজতে পড়ে থাকে। কখনও পুলিশ, কখনও আইনজীবী, কখনও বিচারক মুখোশ পরে বাস্তব সত্যকে আড়াল করেন। সেখানে সত্যের জন্য কেউ লড়াই করে না—বরং নিজেদের রক্ষা করতে সত্যকে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়।
এই সমাজে এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজেকে চেনা। আমরা নিজের মুখ দেখে গর্বিত নই, তাই মুখোশ পরে থাকি। আমরা স্বীকার করি না, আমরা দুর্বল। আমরা বলি না, আমরা লোভী। আমরা স্বার্থপরতার নাম দিই "প্রয়োজন", আমরা প্রতারণাকে বলি "চালাকি", আমরা ভণ্ডামিকে বলি "কৌশল"। অথচ এইসবই আমাদের ধীরে ধীরে প্রাণী করে তুলছে, যেখানে হৃদয় নেই, বিবেক নেই—আছে শুধু মুখোশ আর অভিনয়।
তবে এই মুখোশ থেকে মুক্তির পথ একেবারে বন্ধ নয়। এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা সত্য বলেন, ভুল স্বীকার করেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন, ভালোবাসেন মন থেকে, প্রতিবাদ করেন সাহসে। তারা সংখ্যায় কম, কিন্তু তারাই আশা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত আত্মজিজ্ঞাসা করা—"আমি কে? আমি কি নিজেকে চিনতে পারি?" যদি অন্তত একজন মানুষ তার নিজের মুখোশ খুলে ফেলতে পারে, তবে সমাজে আলোর রেখা দেখা যাবে।
এই পৃথিবী অনেক বড়, অনেক সুযোগ রয়েছে ভালো মানুষ হওয়ার। মুখোশ পরে বাঁচা সহজ, কিন্তু সেটি বাঁচা নয়—সেটি প্রতিদিন মরে যাওয়া। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে প্রাণীর মতো ছলনার জীবন বেছে নেওয়া যেন নিজেরই অপমান। মুখোশ খুলে নিজের মুখে তাকানোই আমাদের একমাত্র মুক্তির পথ।
সত্যিকারের মানুষ হতে গেলে বড় কোনো ত্যাগের দরকার নেই—শুধু দরকার সাহস, সরলতা, সততা আর বিবেক। একদিন আমরা সবাইকে চেনা যাবে—মুখ নয়, মন দিয়েই। তখন আর কোনো মুখোশ থাকবে না, থাকবে মানুষ – একদম সত্যিকার মানুষ।
শেষ কথা —
মুখোশে ঢাকা জীবন নয়, সত্যিকার মানুষ হওয়ার সাহস চাই। কারণ, মুখোশে মুখ হাসে, কিন্তু মন কাঁদে।
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753
https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL