আপনি যদি রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক হন -সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিমালা, নৈতিকতা ও কার্যপ্রক্রিয়ার মৌলিক ধারণা থাকা আবশ্যক। কেননা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ভার বহন শুধুমাত্র অফিসের ফাইল স্বাক্ষর মাত্র নয়, বরং তা রাষ্ট্রীয় নির্ভরতার প্রতীক। অথচ যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তা যেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের নবতর প্রতিধ্বনি। তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিয়ে যেভাবে হুটহাট ফেসবুকে লিখছেন তাতে তার শিশুসুলভ বালখিল্যতার পরিচয়কে সামনে আনছে এবং ব্যক্তিত্বের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর ব্যাগ থেকে একটি পি'স্তলের ম্যাগাজিন উদ্ধারের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড়। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নিজের ফেসবুক আইডিতে উপদেষ্টা লিখলেন, “গতকালকের ঘটনায় এটা বুঝতে পারলাম যে, পিস্তল কেন, মিসাইল সঙ্গে রাখলেও আমি, আপনি কেউই নিরাপদ নই।”
এই বক্তব্য শুধু ভাবনায় ফেলে না, বরং দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে এমন উদ্বেগজনক মন্তব্য রীতিমতো আতঙ্ক ছড়ায়।
তাঁর ২৩ লাখ অনুসারীসংবলিত আইডি ভেরিফায়েড না হলেও এটি তাঁর নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ, যেখানে তিনি দাপ্তরিক নয়, বরং ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু এই মতামত এতটাই বিস্ময়কর ও বিভ্রান্তিকর যে, প্রশ্ন ওঠে -আমরা কী আসলে কোনো ভিন্নমুখী কর্তৃত্বের মুখোমুখি?
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, কীভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ মুহূর্তেই বিদেশে পৌঁছে গেল। সন্দেহ প্রকাশ করেন, এই ধরনের ‘তথ্য পাচারকারী’ গোষ্ঠী দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী বা গুপ্তচর সংস্থার সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।
এখানে প্রশ্ন, কাকে ঘিরে আসল শঙ্কা? তথ্য ফাঁস, নাকি তথ্যের ভেতরে থাকা গোপন কোনো সত্য?
আসিফ মাহমুদ আরো লেখেন, “আমি সরকারে আছি। আমার সাথেই যদি এমনটা হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা কোথায়?” আবার বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের সঙ্গে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে, কারা ঘটাল তা বোঝা কঠিন হবে না।” এই বক্তব্য নিছক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং তা এক অশনিসঙ্কেত বহন করে। এ যেন সাংবাদিকতা ও নাগরিক জবাবদিহিতার বিরুদ্ধে এক সুগভীর অবিশ্বাসের ঘোষণা।
লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের একে গণমাধ্যম সম্পর্কে অজ্ঞতা নয়, বরং একটি বিপজ্জনক কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার প্রকাশ বলে আখ্যা দেন। তাঁর ভাষায়, এই বক্তব্য শেখ হাসিনার শাসনামলের দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। যখন রাষ্ট্রের চোখ প্রতিপক্ষের ওপর নয়, বরং নাগরিকের ওপর নজরদারিতে ব্যস্ত হয় -তখন গণতন্ত্র লঘু হয়ে যায়, রাষ্ট্র হয়ে ওঠে আতঙ্কগ্রস্ত প্রহরী।
সাংবাদিকতা কখনোই সন্ত্রাস নয়। তথ্যপ্রকাশ কখনোই অপরাধ নয়। সত্য প্রকাশের দায় বহনকারী হুইসেলব্লোয়াররা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের মাটিতেও বহু সাহসী মানুষ নির্যাতন, দুর্নীতি ও অনিয়মের দলিল সাংবাদিকদের কাছে পাঠান। সেইসব মানুষদের ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ বানানোর মানে হচ্ছে, সত্যকে বন্দি করতে চাওয়া।
প্রকৃত প্রশ্ন আসলে একটাই -বিমানবন্দরে কী এমন ঘটেছিল যা প্রকাশ হওয়ায় উপদেষ্টা এতোটা ক্ষুব্ধ? যদি কোনো মন্ত্রী বা তার আত্মীয়ের পিস্তলবাহী ব্যাগ ধরা পড়ে, সেটি কি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন নাকি ব্যাক্তিগত দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন?
মিস্টার সায়ের লিখেন, 'তাঁর এই বক্তব্য মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য স্পষ্ট হুমকি। ফুটেজ ফাঁসকে যদি জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে এরা পরিণত হচ্ছে কেবল আগের সরকারে একটা কার্বন কপি হিসেবে। যদি অনিয়মের তথ্য উন্মোচন করাকে অপরাধ বানানো হয়, তাহলে জবাবদিহিতার কী আর বাকি থাকে?
এই মানসিকতাকে বিনা দ্বিধায় নিন্দা করতে হবে। সাংবাদিকতা সন্ত্রাস নয়। দুর্নীতি উন্মোচন গুপ্তচরবৃত্তি নয়। সত্য উন্মোচনকারীদের রক্ষা না করে যদি এই সরকার তাদের দমন করতে চায়, তবে এই অন্তর্বর্তী সরকার কেবল নাম বদলানো পুরোনো স্বৈরতন্ত্রিক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে -আরও বেশি অহংকার ও দায়মুক্তির ভয়বহতা নিয়ে।'
তাঁর আগ্নেয়াস্ত্রের যদি বৈধ লাইসেন্স থাকে সেটা স্বীকার করে ভুলে ম্যাগাজিন বহনের ব্যাপারটিতে দুঃখপ্রকাশই শেষ খবর হওয়ার কথা ছিল। তা না করে বরং তিনি বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতার উপর দোষ চাপানোর পথ। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাব খাটিয়ে তিনি কিছু সংবাদ মাধ্যমকে নিউজ সরাতেও বাধ্য করেছেন।
এমন আচরণ মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য এক ভয়ানক বার্তা। এটি কেবল স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ নয়, বরং এক নতুন কর্তৃত্ববাদের অশুভ কণ্ঠস্বর। তাঁর বক্তব্য পাঠ করে বিরাট এক প্রশ্ন সামনে এসে দণ্ডায়মান হয় -আমরা আসলে কাকে দিয়ে কী বদলাতে চেয়েছিলাম?
লেখক: সাংবাদিক
৩০ জুন ২০২৫