Posts

গল্প

মৃত্যুর ধাঁধা

July 2, 2025

MD RAYHAN

167
View

ট্রেনের গল্প: "মৃত্যুর ধাঁধা"

রাত তখন সাড়ে দশটা। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি লোকাল ট্রেন নির্জন স্টেশনে এসে থামল। স্টেশনটি ছোট এবং জনমানবহীন। চারপাশে কুয়াশার চাদর, আর মাঝে মাঝে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাত্রীদের ভিড় নেই, কেবল হাতে গোনা কয়েকজন। ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট কামরার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সোহান।

সোহান একজন প্রকৌশলী। কাজের সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাকে। আজও তিনি অফিসের কাজে গিয়েছিলেন ঢাকার বাইরে। ফেরার পথে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় উঠেছেন। কামরাটি প্রায় খালি, কেবল কয়েকজন বৃদ্ধ এবং একটি অল্পবয়সী দম্পতি।

কথা বলার সূত্রপাত

কিছুক্ষণ পর একটি নতুন স্টেশনে থামল ট্রেন। একজন মধ্যবয়সী লোক কামরায় উঠলেন। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, আর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। লোকটি সোহানের পাশে এসে বসল। প্রথমে সোহান তার দিকে খেয়াল করেনি। কিন্তু লোকটি নিজেই আলাপ শুরু করল।

“আপনার নাম সোহান, তাই না?”

সোহান অবাক হয়ে তাকাল।
“আপনি কীভাবে জানলেন?”

লোকটি মুচকি হেসে বলল, “আমি সব জানি। এমনকি আপনি যেখানে যাচ্ছেন, সেটাও।”

সোহান কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করল। “আপনি কে?”

লোকটি বলল, “আমার নাম জানার চেয়ে বরং আপনি যা খুঁজছেন তা নিয়ে ভাবুন।”

সোহান এবার পুরোপুরি বিভ্রান্ত। তিনি কিছু বলার আগেই লোকটি উঠে গেল।

ট্রেনের রহস্যময় পরিবর্তন

কিছুক্ষণ পর সোহান খেয়াল করল, ট্রেনটি অদ্ভুতভাবে ধীরগতিতে চলছে। যেন কোনো ভুল সময়ের মধ্যে আটকে আছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল গভীর অন্ধকার, কোনো স্টেশন বা আলো নেই। এমনকি ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দও যেন ম্লান হয়ে গেছে।

আচমকা ট্রেনের ভিতর একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল। চারপাশ থেকে আর্তনাদের শব্দ ভেসে এলো। সোহান দ্রুত উঠে দেখল, তার সহযাত্রীদের চেহারায় আতঙ্ক। যে বৃদ্ধ দম্পতি শান্তভাবে বসে ছিলেন, তারা কাঁদছেন।

তাদের জিজ্ঞাসা করতেই তারা বললেন, “আমরা এখানে আটকে আছি অনেকদিন ধরে। এই ট্রেন থেকে বের হওয়া অসম্ভব। এটা মৃত্যুর ট্রেন।”

একটি পুরনো গল্প

এক বৃদ্ধ সোহানকে বললেন, “এই ট্রেনের আসল কাহিনি শোন। প্রায় ২০ বছর আগে এই একই ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। ট্রেনটি রেললাইন থেকে ছিটকে গিয়ে নদীতে পড়ে যায়। সেই ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়। তাদের আত্মারা এখানেই আটকে আছে।”

সোহান বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমি তো জীবিত! আমি এখানে কীভাবে এলাম?”

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি আমাদের মতো নয়। তবে তুমি এই ট্রেনের যাত্রা শুরুর পর থেকেই এর শিকার। তুমি একাই এর থেকে মুক্তি পেতে পারবে।”

মুক্তির পথ খোঁজা

সোহান ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে পড়ে গেল। ট্রেনের প্রতিটি কামরায় ঘুরে দেখতে লাগল। একটি নির্জন কামরায় ঢুকে সে দেখল যে দেয়ালে পুরনো খবরের কাগজ লাগানো। সেই খবরের শিরোনামে লেখা: “দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের আরোহীদের সন্ধান মেলেনি।”

সোহান মনে মনে ঠিক করল, এই ধাঁধার সমাধান করতে হবে। ট্রেনের প্রতিটি কোণে খুঁজতে গিয়ে সে সেই অদ্ভুত লোকটির সামনে এসে পড়ল, যিনি তার নাম জানতেন।

লোকটির রহস্য উদঘাটন

লোকটি বলল, “তুমি বুঝতে পেরেছ, এই ট্রেন থেকে মুক্তি পেতে হলে তোমাকে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। এই ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট কামরায় একটি কুয়াশার দরজা আছে। সেটা পার করতে পারলেই তুমি মুক্তি পাবে।”

সোহান জানতে চাইল, “কোন কামরা?”

লোকটি ইঙ্গিত করল সামনের দিকে।

শেষ যাত্রা

সোহান দ্রুত ওই কামরার দিকে এগোল। কামরাটি একেবারে অন্ধকার। এক পাশে একটি দরজা দেখা যাচ্ছে, যা খোলা। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে সোহান দেখল, বাইরে কুয়াশার মধ্যে একটি ব্রিজ। কিন্তু সে যদি এই ব্রিজ পার হয়, তাহলে কী হবে, সে জানে না।

অবশেষে সাহস করে সোহান দরজা দিয়ে বেরোল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে চলতে চলতে সে দেখতে পেল ট্রেনটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার পেছনের সব কিছুই যেন মুছে যাচ্ছে।

নতুন সূচনা

সোহান হঠাৎই নিজেকে একটি অন্যরকম পরিবেশে আবিষ্কার করল। সে এখন একটি ব্যস্ত স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে মানুষজন, আলো আর চঞ্চলতা। সে বুঝতে পারল, সে জীবনের সাধারণ ধারায় ফিরে এসেছে।

কিন্তু ট্রেনের সেই যাত্রা আর সেই লোকটির কথা কখনোই ভুলতে পারল না সোহান। আজও সে রাতে নির্জন ট্রেনের আওয়াজ শুনলে মনে মনে ভাবে, “আমি কি সত্যিই বেঁচে ফিরেছিলাম, নাকি এখনো সেই মৃত্যুর ট্রেনের যাত্রী?”

Comments

    Please login to post comment. Login