পর্ব ১: মাটির ঘরের স্বপ্ন (সম্পূর্ণ)
ঢাকার এক বস্তির কাঁচা রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা মাটির ঘর। ঘরটি এতই ছোট যে সেখানে আরেকজন বসতে পারতো না। চারিদিকে কাদা, পলিথিনের ছাউনি, ঝরে পড়া ছেঁড়া কাপড় আর ফুটপাথে বসে থাকা মানুষ। এই অন্ধকার, কষ্ট আর দারিদ্র্যের মধ্যে একটা ছোট্ট ছেলে বসে থাকে — রাকিব।
রাকিবের বয়স তখন মাত্র ১৩, কিন্তু চোখে তার ছিল সাগরের মতো গভীর স্বপ্ন। সে জানত সে গরিব, কিন্তু স্বপ্নে গরিবত্বের কোনো স্থান ছিল না। তার বাবা ছিল রিকশাচালক। সকাল থেকে সন্ধ্যা, দৌড়ে বেরিয়ে পড়ত শহরের গরম, ভীড় আর যানজটের মাঝে। যে টাকা রোজ আয় হতো, সেটাই ঘরে ফিরত। কিন্তু সেই আয় দিয়ে পুরো পরিবারের জীবন চালানো ছিল দায়সারা ব্যাপার।
রাকিবের মা ছিল গৃহিণী। ছোট দুই বোন ও তার দেখাশোনা করতেন। কদিন না কাটল, রাকিবের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কাজ করতে পারছিলেন না ঠিকমতো। রাকিবের দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক গুণ।
শিক্ষা ছিল তার একমাত্র আশা। প্রতিদিন স্কুল যেত, যদিও স্কুলের পথে ধুলো আর কাঁদা পথ তাকে বাধা দিত। কখনো খাবারের অভাবে পেট খালি ক্লাসে বসতে হত। অনেক দিন স্কুলে যাওয়ার জন্য টিউশনি বন্ধ রাখতে হয়েছে।
স্কুলের স্যার একদিন পুরনো, নষ্ট হয়ে যাওয়া কলম রাকিবকে দিলেন। বললেন, "এই কলম দিয়ে তুমি তোমার ভাগ্য লিখবে।" রাকিব সেই কলম হাতে নিয়ে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি পেল।
তার স্বপ্ন ছিল বড়—ডাক্তার হবে, নিজের পরিবারকে গরিবত্ব থেকে মুক্ত করবে, শহরের বড় বড় অফিসে চাকরি করবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। একদিন রাতে রিকশা চালিয়ে ফিরতে গিয়ে বাবার রিকশাটি চুরি হয়ে গেল। পরের দিন পরিবারের পেটের খবর নিতে গিয়ে দেখা গেল, খাবার নেই।
রাকিব ভেঙে পড়ল না। ছোট ছোট কাজ করতে লাগল। দোকানে কাঁচামাল বয়ে নিয়ে যাওয়া, রাস্তা পরিষ্কার করা, অনেক সময় অন্য কারো রিকশা চালানো। ক্লাস শেষে রাস্তায় বসে নিজের বইয়ের পাতা ফেরত দেখত, আর ভাবত—কবে আমি বড় হবো?
একদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে দেখতে পেল এক ছোট বাচ্চা, তার দুই পা নেই। সেই বাচ্চার চোখে সে নিজের মতই স্বপ্নের ঝিলিক দেখল। সে বুঝল, তার মতো হাজার হাজার মানুষের জীবনেও আছে কঠিন সংগ্রাম, তবুও তারা হাল ছাড়ে না।
তার বাবা কিছুতেই ভালো হয়ে উঠতে পারছিলেন না। সংসারে চাপ দিন দিন বেড়ে চলল। রাকিব জানত, পড়াশোনা ছাড়লে সব শেষ হয়ে যাবে। তাই রাত জেগে পড়াশোনা করত, গলাকাটা আলোয় নিজের ভবিষ্যৎ আঁকত।
একদিন স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে সে দেখল তার এক বন্ধু গরমে কাঁপছে, খেতে পারছে না ঠিকমতো। সে নিজেই তার রুটি ভাগ করে দিল। আর সেই মুহূর্তেই রাকিব বুঝল, জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ টাকা নয়, ভালোবাসা।
তবুও জীবনকে হার মানাতে দেয়নি সে। প্রতিদিন নিজের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করে গেল, চোখে ভরা স্বপ্ন নিয়ে।