খিচুড়ি পর্বের কথা বলতে গিয়ে অন্য দিনের কথাই বলে ফেললাম। আসলে একটা ঘটনা বলতে গেলে তার সঙ্গে অনেকগুলো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এত স্মৃতি!!!! একটা কথা প্রায়ই শুনে থাকি, আর তা হলো—"আপনি যদি কাউকে আপনার ভালবাসায় ফেলতে চান, তবে তার সঙ্গে আপনার অনেক স্মৃতি তৈরি করা উচিত।" আমার কতো যে স্মৃতি রয়েছে সোহাগকে কেন্দ্র করে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে সেই স্মৃতিগুলোর অধিকাংশই দুঃস্বপ্নের মতো।
এবার খিচুড়ি পর্বে ফিরে যাই—তো সেদিন আমি প্রথম রাউন্ডে পাশ করেছিলাম। অর্থাৎ, আমাকে দেখতে ওর ভালো লাগছিল, যা অনেকটা প্রাণে বেঁচে যাওয়ার মতো বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ও যখন টিফিনবক্স আমার হাত থেকে নিয়ে আমার সামনে খুলল,ওর প্রথম কথাই ছিল হল,“চামচ কই,চামচ দাও।” আমার হাত-পা পুরো ঠান্ডা হয়ে গেল। ও চামচ চাইছে মানে, আর কোনও বিকল্প ও গ্রহণ করবে না—অন্তত আমাকে বিপদে ফেলানোর বা অপরাধী বানানোর জন্য হলেও। আমি বললাম, “ওহ, চামচটা আনতে ভুলে গেছি। তুমি বরং হাত দিয়েই খাও।” ও বলল, “তুমি চামচ আনোনি? কেন আনোনি?” আমি বললাম, “অনেক তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে ভুলে গেছি।” সোহাগের চোখ ক্রোধে আস্তে আস্তে লাল হয়ে যেতে থাকলো। সে অনেক ক্ষুধার্ত, কিন্তু আমার বিচার করাটাই যেন তার প্রথম অগ্রাধিকার—যদিও সে আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেনি যে আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি কিনা। ও আমায় বলল, “আমি এখন কীভাবে খিচুড়ি খাবো, বল তুই?”
এখনো মনে পড়ে, সোহাগ বারবার এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল—কেন আমি চামচ আনলাম না, আর এখন ও কিভাবে খাবে। আর এদিকে আমি বারবার ওকে ‘সরি’ বলেই যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে ওর সামনে দু’হাত জোড় করে বললাম, “আজকের মতো মাফ করে দাও। আর কোনোদিন এমন ভুল হবে না।”
সোহাগ টিফিন বক্সটা ঠাস করে ফেলে দিলো মাটিতে, সব খিচুড়ি রাস্তার উপর ছড়িয়ে পড়ে থাকলো। ওর জন্য পানির বোতলও এনেছিলাম, সেই বোতল এত জোরে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলল যে বোতল ফেটে পানি বের হয়ে গেল। আমি লোকজনের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা খিচুড়ি দেখে চোখটা ছল ছল করে উঠলো। প্রতিবারই অনেক সাবধান থাকার চেষ্টা করেও কোনো না কোনো ভুল করেই ফেলতাম। হয়তো ভয় থেকেই ভুল হতো বেশি—ওই যে কথায় আছে না, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।” অবশ্য সেদিন সৌভাগ্যবশত আমি মার খাইনি ওর হাতে।
দুপুরে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে কিছু না খেয়েই চলে এসেছিলাম ওর খাবারটা নিয়ে।যদিও আমার খুব খিদে লেগেছিল। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় প্রখর রোদের মধ্যে একটা অসহায় মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বারবার তার প্রেমিকের কাছে ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছে তাও আবার কোন অপরাধ না করেই।
সোহাগ আমাকে কাঁদতে দেখলে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পেত আর বলতো, “কাঁদবি না খবরদার, ন্যাকা কান্না আমার সামনে দেখাতে আসবি না।” আর সাথে এটাও বুঝতো—আমি খুব সহজ-সরল, খুব তাড়াতাড়ি নার্ভাস হয়ে যাই। ওর খুব ভালো লাগতো বিষয়গুলো। ওই যে হয় না, আমরা পিঁপড়ের সামনে হাত দিয়ে আটকে রাখি যাতে ও চলতে না পারে, ছুটোছুটি করতে থাকে এদিক-ওদিক—আর আমরা বারবার রাস্তা বন্ধ করে দিই। কিন্তু ভেবে দেখবেন, এই কাজটা আমরা সব প্রাণীর সঙ্গে করি না, কারণ আমরা কারো বোকামি দেখে মজা পাই । আমি ছিলাম ওই ধরনের একটা বোকা প্রাণী, আর আমার বোকামিগুলো ছিল ওর কাছে বিনোদনের মতো। আমি ওই দিন বাড়ি ফেরার পর প্রচণ্ড বমি করেছিলাম। মনে হচ্ছিল রাস্তার পড়ে থাকা খাবারটাই যেন আমিই গলাধঃকরণ করেছি। কিন্তু সেদিন আমি বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলাম পূর্বের অভিজ্ঞতার কারণে। আমি জানি, আমি যত কম প্রতিবাদ করবো, ততো অত্যাচারটা কম হবে আমার উপরে। তাহলে অন্তত আমি ঠিক সময়ে বাসায় ফিরতে পারবো।
বাড়ি ফেরা নিয়ে আমার সতর্ক থাকাটা ইতোমধ্যে হয়তো বেশ কয়েকবার বলেছি, তবে বিস্তারিত কারণটা বলা হয়নি। আসলে সোহাগের সাথে একবার তুমুল ঝগড়া করার পর আমি অভিমান করে ওর সামনে থেকে কিছু না বলে বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম। আমাদের বাসার গেট দিয়ে ঢুকলে তিন-চারটা বিল্ডিং পরেই আমাদের বাড়ি।
গেট ক্রস করে সামনে আগানোর পরে বাসার কাছে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হলো কেউ যেন পেছন থেকে ধপধপ শব্দ করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই সোহাগ আমার গালে তিন-চারটা চড় বসিয়ে দিলো,তাও এক গালে নয় দুই গালেই । এরপর দু’হাত দিয়ে শক্ত করে আমার গলা টিপে ধরলো। আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে চোখের পলক পর্যন্ত ফেললাম না । কিছুক্ষণ পর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, “তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি এখনই আসছি।” সোহাগ বললো সে নাকি এখনই আমার বাসায় গিয়ে আমার মা-বাবাকে বলবে আমাদের সম্পর্কের কথা—শুধু তাই নয়, আমাদের কিছু ব্যক্তিগত ছবিও আমার মা-বাবাকে দেখাবে। আমার খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “আমার ভুল হয়েছে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি তোমাকে না বলে।” ও বলল, “এখন কেন এত নরম গলায় কথা বলছিস? একটু আগে তো কোমর দুলাতে দুলাতে আমাকে বা পা দিয়েও না গুনে চলে গেলি।”
“বললাম তো সোহাগ, ভুল হয়েছে আমার।”
সোহাগ বললো, “আসলে তোকে অনেক প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি, এজন্যই আজ তোর এই অবস্থা। আমি ভুলে গেছিলাম যে পায়ের জুতা কখনো মাথায় পড়া যায় না।” কথাটা বলার পর সোহাগ আমাকে বললো, “পাঁচ মিনিটের মধ্যে গেটের বাইরে আসবি। এক সেকেন্ডও যদি দেরি করিস, তাহলে আমি ঠিক এক সেকেন্ডের মধ্যেই তোর বাসায় এসে উপস্থিত হবো।” তাও ভালো,পাড়ার লোকজনের সামনে আমার হাত টেনে হিচরে ধরে নিয়ে যায়নি, নয়তো আমার এই দুরবস্থার কথা আমার প্রতিবেশীদের কাছেও অজানা থাকত না। ও চলে যাওয়ার পরে আমি একরকম দৌড়ে গিয়ে বের হলাম বাসার সিঁড়ি থেকে গেট পর্যন্ত।
সেদিন পরে ওর সঙ্গে আমি একটা রেস্টুরেন্টেও গিয়েছিলাম। ও এতটাই স্বাভাবিকভাবে খাচ্ছিল, যেন কিছুই হয়নি। মিষ্টি একটা হাসিও দিলো আর বললো আমাকে, “বিপাশা, তুমি খাচ্ছো না কেন?” আমি বললাম, “আর খেতে পারছি না।” সোহাগ হাসিমুখে বললো, “দাও আমাকে তোমার নুডলস, আমি খেয়ে ফেলি বাকি টুকু।” কথার মাঝে কোনও জড়তা নেই,কি নির্বিকার!!!কে বলবে এই মানুষটাই একটু আগে আমার উপর এত হিংস্র ভাবে আক্রমণাত্মক ছিল।খুব বিস্মিত হতাম—ও কিভাবে এত সহজে স্বাভাবিক হয়ে যেত এত জঘন্য আচরণ করার পরেও। কিন্তু সোহাগ কোনোদিনও আমাকে ‘সরি’ কথাটা বলতো না। আর প্রত্যেকবার ও যখন ভালো ব্যবহার করতো, আমি ভাবতাম—আর হয়তো কখনো ও আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না।এই ভুল ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে আমার পাঁচ বছর কেটে গেল সোহাগের সাথে।
সম্পর্কের প্রথম ৬-৭ মাস আমি ওর এই ভয়ানক রূপের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। বরং সেই সময়টাতে ও আমার সঙ্গে ফোনে ঠিকমতো কথা বলতো না বলে আমার ভীষণ অভিমান হতো।
ওর কাছ থেকে প্রথম ধাক্কার কথা আমার এখনও মনে আছে।