ব্যর্থতা….
📖 অধ্যায় ১: একাকীত্বের সংসার
“কখনো কখনো ঘরটা থাকে, কিন্তু তাতে ‘বাড়ি’ বলে কিছু থাকে না।”
---
সকালবেলা ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁয়েছে। পাশের বাসা থেকে ভেসে আসছে ডালের ফোড়নের গন্ধ, রাস্তায় বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার কোলাহল, আর দূরের রিকশার ঘণ্টা। কিন্তু রুদ্রের ঘরে কেমন একটা অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা। যেন সময়ও এখানে থেমে গেছে।
রুদ্র চোখ মেলে তাকায় ছাদের দিকে। ফ্যানটা কেবল ঘুরছে—নিয়ম করে, ক্লান্তভাবে। জানালার পর্দা সরিয়ে যখন সে আলোর মুখ চায়, তখন শুধু ধুলোমাখা গ্রিল আর পাশের পাঁচ তলার দেয়াল দেখা যায়। এটাই তার সকাল—একঘেয়ে, শব্দহীন, নিঃসঙ্গ।
তার মায়ের মুখেও কোনো শব্দ নেই। তিনি কিচেনে ঢুকেছেন নীরবে, যেন নিজেকেই শোনাতে চান না। বাবার ঘরে এখনো বাতি জ্বলে না—তিনি ঘুমিয়ে আছেন, হয়তো বিগত রাতের নেশায় ডুবে থাকা শরীরটা তখনো বাস্তবে ফেরেনি।
রুদ্রের জীবন একটা ‘স্টক ইমেজ’ হয়ে গেছে—যেখানে প্রতিদিন একই দৃশ্য, একই কষ্ট, আর একই পরিণতি।
---
একসময় এই ঘরেই হতো বেঁচে থাকার চেষ্টার উৎসব। বাবা ছিলেন গর্বিত। স্কুলের সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে বলতেন, “আমার ছেলেটা বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে!” রুদ্রও বিশ্বাস করত—সে পারবে। কিন্তু জীবন যে বিশ্বাস রাখে না, সেটা সময়ের সাথে শিখে গেছে সে।
একটা সময় ছিল, যখন বাবার চোখে ছিল স্বপ্ন। কিন্তু চাকরি হারানোর পর থেকে সেই স্বপ্নগুলো কোথায় যেন উবে গেল। ঘরে এল বিষণ্ণতা, এল মদের গন্ধ, এল চিৎকার। বাবা বদলে গেলেন। এখন শুধু মদের বোতল হাতে আর কন্ঠে অভিযোগ—“তোর জন্যই আমার জীবন শেষ! তুই কিছুই পারিস না।”
রুদ্র মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কোনো দৃষ্টি নেই, আছে শুধু সহ্য করার শক্তি। মা কারও সামনে কাঁদেন না, এমনকি নিজের সামনে নয়। শুধু চুপচাপ কাজ করেন, রান্না করেন, আর মাঝে মাঝে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করেন, “আজ কোথাও গেছিস?”
সে উত্তর দেয় না সবসময়। কি বলবে? আজও কোনো অফিসে সে দরজা পর্যন্ত গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরে ডাকা হয়নি। যে জীবন একসময় ছিল সম্ভাবনার, এখন তা শুধুই উপহাসে পরিণত হয়েছে।
---
রুদ্রের বন্ধুরা এখনো আছে—তবে মোবাইলের স্ক্রিনে, গ্রুপ চ্যাটে। বাস্তব জীবনে তারা কেউই তাকে ডাকেনা আর। বেকার মানুষ সামাজিক মঞ্চে দাঁড়ানোর অনুমতি পায় না। যে বন্ধুটি একসময় রাতভর গল্প করত, সেই এখন ব্যস্ত "লিংকডইন প্রোফাইল" সাজাতে। জীবন যেন একটা প্রতিযোগিতা, আর রুদ্র সেই দৌড়ের শুরুতেই হোঁচট খাওয়া প্রতিযোগী, যাকে সবাই পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে গেছে।
কিন্তু রুদ্র কোথায় যাবে? যেদিন থেকে তার মনের মধ্যে এক ধরনের স্থায়ী ক্লান্তি বাসা বেঁধেছে, সেদিন থেকেই সে বুঝে গেছে—তার জীবনের সমস্যা কেবল টাকার না, ‘উপস্থিতি’রও। সে আছে, কিন্তু তার কোনও জায়গা নেই।
---
রাতে বাবা ফিরেন একটু বেশি মাতাল হয়ে। চেয়ারে বসে বলেন, “একটা কাজ করতেও পারিস না! কলেজে কত টাকা দিলাম! শেষমেশ তো তুই ঘরে বসে মা’র ভাত খাচ্ছিস!”
রুদ্র চোখ নামিয়ে রাখে। সে কখনো বাবার সঙ্গে তর্ক করে না। করলেই ঝড় বয়ে যাবে। মা এসে চুপচাপ দাঁড়ান। তার হাতের শিরা ফুলে ওঠে, মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখে এক গভীর দুঃখ। যেন তিনি বলতে চান, “আমরা কেউ ভালো নেই রুদ্র, কিন্তু এই সংসার ভাঙা যাবে না।”
সে রাতে ঘুম আসে না। সে ডায়েরি খোলে। প্রথম পাতায় লেখে:
> “আমি কেউ না। আমি শুধু সেই মানুষ, যাকে জীবন জিজ্ঞেস করে—তুই কেন এখনো বাঁচিস?”
---
এভাবে প্রতি রাতে সে লিখে যায়। কথা বলতে পারে না মা’র সাথে, বাবার সাথে তো নয়ই। বন্ধুদের এখন আর ফোন দিতে ইচ্ছেই করে না। সমাজ তাকে মুখ ফুটে বলতে দেয় না—সে ব্যর্থ নয়, সে চেষ্টা করছে।
সে এক অদ্ভুত শব্দবিহীন যুদ্ধের সৈনিক। সে লড়ছে, কিন্তু কেউ জানে না। তার অস্ত্র কেবল কিছু শব্দ—ডায়েরির পাতায় জমে থাকা স্বপ্ন আর ভেঙে পড়ার গল্প।
---
ডায়েরির একটি পাতায় সে লিখেছে:
> “বাবা, তুমি কি একদিন আমার দিকে তাকিয়ে বলবে—তুই পারিস? মা, তুমি কি একবার জড়িয়ে ধরে বলবে—তুই ক্লান্ত হ হয়ে পড়িস না?”
“আমি শুধু চাই—একদিন কেউ আমাকে বুঝুক, ব্যর্থতার মধ্যে ডুবে গেলেও আমাকে গালি না দিক। আমি তো শুধু মানুষ হতে চেয়েছিলাম...”