Posts

প্রবন্ধ

নবী ও কবি

May 25, 2024

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

Original Author শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

নবী ও কবি। নবী সত্যের বাণী প্রচার করেন। আর কবি সুন্দরের বাণী। সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক হলেও সুন্দর চিরায়ত ব্যাপার। সেই সুন্দরের কথা বলেন কবি। কবির আগমন সবকিছুকে ভেদ করে, উদ্ভাসিত করে, উলট-পালট করে। কবি বলেন, অন্যরা শুনেন। অন্যদের কাজ শুনা, বলা নয়। এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, সেই সুন্দর চিহিৃত করা, সুন্দর আবিস্কার করা, সুন্দরের পূজা কবিই আমাদের শিখিয়েছেন। কবি মানুষকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন, ভাবতে শিখিয়েছেন, সৃষ্টি করতে শিখিয়েছেন। কবি তিনিই, যাঁর জন্য এই পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠে, অনিন্দ্য হয়ে উঠে। না হয় সুন্দর বলতে, নান্দনিক বলতে আর কিছুই থাকে না। যা কিছু অ্যাকাডেমিক্যাল-গ্রামাটিক্যাল কবি তার চেয়েও বড় কিছু, তার চেয়েও মহৎ কিছু। কবি যেমন প্রেম শেখান, ভাবতে শেখান, তেমনি শেখান প্রতিবাদও।

‘বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়।’ নার্গিসের প্রতি নজরুলের চিঠির একটি অংশ। জানি না এর চেয়ে সুন্দর, এর চেয়ে নান্দনিকভাবে কে প্রকাশ করতে পেরেছে। চিঠির প্রতিটি বাক্যই চিরায়ত। প্রতিটি নির্মাণ অনন্য। 
নজরুলকে যেভাবে আমরা বিদ্রোহী কবি জানি, ঠিক তারচেয়েও মহৎ তিনি প্রেমের কবি হিসেবে। ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন ওগো অন্তর্যামী’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে’ কিংবা ‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন’ ইত্যাদি প্রেমের গান এর চেয়ে সুন্দর করে কে লিখতে পেরেছেন? অথবা নার্গিসের প্রতি নজরুলের চিঠিগুলো বাংলা সাহিত্যে কেন, চিঠি সাহিত্যের ইতিহাসেও বিরল। 

নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন মাত্র ২২ বছরের। এই অল্প সময়ে তিনি পৃথিবীকে যেভাবে ঝাকুনি দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত অন্যকেউ এমন ঝাকুনি দিতে পারেননি। তখন পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে বৃটিশ শোষণ চলছে। সেই শোষণের বিরুদ্ধে নজরুল বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন। উচ্চারণ করেছিলেন- ‘আমি ভগবানের বুকে একে দেই পদচিহ্ন/ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’ ইত্যাদি। সুতরাং আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন, সেই ভাষায় বিদ্রোহের বাণী রচিত হয়েছে। সেই ভাষা রক্তঝরা। সেই ভাষা প্রেমের ও দ্রোহের। 
রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কে আমরা কবি হিসেবে চিনলেও দুজনই ছিলেন বড় সঙ্গীতজ্ঞ। বিশ্বসাহিত্যে গীতিকবিদের মধ্যে এখনও অপ্রতিদ্বন্ধী রবীন্দ্রনাথ। এর পরেই নজরুল। এ দু’কবির কবিতার চেয়েও গানই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে অন্য দুজন কবি আমরা পাইনি যাঁরা সঙ্গীতে এতটা দক্ষ এবং এমনভাবে সঙ্গীতমনস্ক। কবিতার সঙ্গে সঙ্গীতের এমন মৈত্রী তাঁদের দুজনের বাইরে অন্য কোন বাঙালি কবির রচনাতে পাওয়া যাবে না। হাজার হাজার গান তারা রেখে গেছেন। গানে সুর দিয়েছেন, সুর সৃষ্টি করেছেন, সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তাঁরা যেভাবে গানগুলো রচনা করে গেছেন, সুর করে গেছেন এর বাইরে গিয়ে কেউ গাইলে ঠিক মানায় না। হয়ে উঠে না। তাঁদের তৈরি কাঠামোই সুন্দর। এমন কোন বাঙালি পাওয়া দুস্কর, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে তার মাঝে প্রতিবাদের ঝড় উঠেনি কিংবা নজরুলের প্রেমের চিঠি পড়ে অশ্রুপাত করেনি।

নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে ফেসবুকের পাতায় পাতায় মানুষ কবিকে স্মরণ করছেন। সময় যতই যাচ্ছে ততই তিনি আধুনিক হয়ে উঠছেন। জীবন্ত হয়ে উঠছেন। ভেদ করে উঠছেন। নজরুল এমন একজন কোন দল ক্ষমতায় আসতে যেমন লাগে, যেতেও লাগে। সরকারি দলেরও লাগে, বিরোধী দলেরও লাগে। প্রেম করতে লাগে, বিদ্রোহ করতেও লাগে।  বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী মহান ও মহৎ এ কবির ১২৫ তম জন্মদিনে অবিরাম শ্রদ্ধা।

Comments

    Please login to post comment. Login