ঢাকার উপকণ্ঠে একটা অখ্যাত জায়গা — বনগ্রাম। শহর থেকে অনেক দূরে, অথচ অদ্ভুতভাবে মানুষের কথাবার্তায় জড়িয়ে আছে। বহু পুরোনো ইতিহাস, পুরানোকালের রাজবাড়ি, আর কিছু অলৌকিক কাহিনি। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। তবে যারা সেখানে একবার থেকেছে, তারা আর আগের মতো থাকে না।
তেমনই এক রাজবাড়ি — "কালঘর" নামে পরিচিত।
২০১৬ সালের শীতের শেষদিকে, রোজ নামের এক তরুণী তার বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তির খোঁজে এই বাড়িতে আসে। তার বাবা ছিলেন একজন প্রফেসর, ইতিহাসবিদ। তিনি মৃত্যুর আগে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
> "রোজ, যদি একদিন সত্য জানতে চাও, তবে বনগ্রামের 'কালঘর'-এ যেও। ওখানে যা লুকানো আছে, তা শুধু তোমার অধিকার। কিন্তু সাবধান, সত্য সবসময় মুক্তি দেয় না… অনেক সময় বন্দিও করে ফেলে।"
এই অদ্ভুত বার্তার পর তিন মাসের মধ্যেই প্রফেসর রহস্যজনকভাবে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ডাক্তার রিপোর্টে যা-ই থাক, রোজ জানে—ওই মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক নয়।
কালঘর প্রথম দেখা
কালঘরটি চারপাশে পুরোনো আমবাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে। তিনতলা ভবন, মাঝখানে ধসে যাওয়া অংশ, মেঝে ধুলোতে ভরা। ভিতরে ঢুকতেই একটা গন্ধ — পচা কাঠ, পুরোনো কাপড় আর কিছু একটা অতিপ্রাকৃত… যেন মৃত্যু।
রোজের সঙ্গে ছিল তার ছোট ভাই নিরব, আর দু’জন বন্ধু — সাফওয়ান আর অনিক। তারা ভেবেছিল এটা হবে একরকম “হন্টেড হাউস অ্যাডভেঞ্চার”। রোজ চায় বাবার মৃত্যুর সত্য খুঁজে বের করতে, আর বাকিরা চায় একটু মজা।
তবে ঘরে ঢুকেই, মজা শব্দটা যেন হারিয়ে যায়।
বাড়ির দেয়ালজুড়ে অদ্ভুত চিত্র — অর্ধেক পোড়া মুখ, শূন্য চোখ, কাটা হাতের ছাপ। কেউ একজন বলেছিল এগুলো শিল্প — রোজ জানে, এগুলো আর কিছু নয়, কারও ভয়ানক অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য।
তারা তৃতীয় তলায় যায়। সেখানে একটা ঘর — দরজা লাল রঙে রাঙানো, যেন রক্তে লেখা কিছু।
ঘরের ওপর লেখা:
"যে এখানে ঢোকে, সে ফিরে আসে না।"
অনিক হেসে বলে, “ওল্ড স্কুল হরর ক্লিশে!” — আর দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে।
এক মিনিট... দুই মিনিট... তিন মিনিট পেরিয়ে যায়।
কেউ বেরোয় না।
রোজ ও সাফওয়ান দরজা ঠেলে ঢোকে।
ঘরটা খালি। শুধু মেঝেতে একটা আয়না — তাতে ভেসে ওঠে একটা মুখ, যেটা অনিকের নয়।
প্রথম মৃত্যু
তাদের পরদিন সকালে গ্রামে পাওয়া যায়—অনিকের মৃতদেহ। পুকুরে ভেসে উঠেছিল। মুখ ছিল বিকৃত, দুই চোখ কোটরের বাইরে। ডাক্তার বলেছিল আতঙ্কজনিত হার্ট অ্যাটাক।
তবে রোজ জানে — এটা ছিল ‘ওটার’ কাজ।
রোজ বাবার চিঠি আবার পড়ে। তাতে একটা মানচিত্র আঁকা ছিল — বাড়ির নিচে একটা সেলারের ইঙ্গিত।
সে খোঁজে... খোঁজে... অবশেষে একটা গোপন দরজা পায় রান্নাঘরের ভাঙা চুল্লির পাশে।
সেলারে নামে একা।
অন্ধকার, ভিজে মাটি, দেয়ালে হাত দিলে মনে হয় কেউ ছুঁয়ে দিল। টর্চের আলোয় দেখা যায় পুরোনো কাঠের কফিন, চারদিকে ঝুলে থাকা সুতার পুতুল, আর একটা কাগজ— তাতে লেখা:
“তিনজনের রক্ত দিলে সে জেগে ওঠে, আর তবেই দেয় তোমার কাঙ্ক্ষিত সত্য।”
রোজ বুঝতে পারে — এ বাড়ি শুধু ইতিহাস নয়, এক ভয়ংকর চুক্তির দলিল।
রোজ টর্চ জ্বালিয়ে তাকিয়ে ছিল কফিনটার দিকে। কাঠের কফিন, তবে দাগের ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এটা বহু পুরোনো নয়। বরং, ১০–১৫ বছরের বেশি হবে না। কফিনের একপাশে একটা সিল ছিল — তিন মাথাওয়ালা একটা সাপ, যার মুখে রক্ত। নিচে এক লাইন লেখা:
“একবার খোলা মানেই দরজা চিরতরে খুলে দেওয়া।”
রোজ ধীরে ধীরে হাত রাখে কফিনের ওপর। হঠাৎ হিমেল বাতাস বইতে শুরু করে সেলারের ভেতর। দেয়ালের গা বেয়ে এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বর গুঁই গুঁই করে বলে ওঠে:
“তুমি এসেছো… অবশেষে…”
রোজ চমকে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে — কেউ নেই। কিন্তু স্পষ্ট মনে হয়, কেউ ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে।
সেই রাতে রোজ ঘুমাতে পারে না। সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন
এক অন্ধকার ঘরে এক বালিকা কাঁদছে। তার পেছনে লাল শাড়ি পরা এক নারী — চোখে পাথরের মতো ফাঁকা দৃষ্টি।
“তুমি আমাকে মুক্ত করো না কেন?” নারীটি জিজ্ঞেস করে।
“আমি… আমি পারি না,” মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দেয়।
“তাহলে আমি নিজেই করে নেব,” বলেই নারীর হাত থেকে ঝরে পড়ে একটা লোহার রড — যার মাথায় রক্ত জমাট।
রোজ হঠাৎ জেগে ওঠে — গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে। পাশে তাকিয়ে দেখে, নিরব নেই।
সকালবেলা খোঁজ নিয়ে বোঝা গেল, নিরব নিখোঁজ।
সারাদিন খোঁজার পর তার মোবাইল পাওয়া যায় বাড়ির সেলারের এক কোণে। কিন্তু নিরব? নেই।
রোজ বুঝতে পারে — দ্বিতীয় ‘রক্ত’ নেওয়া হয়ে গেছে।
আর বাকি আছে একটাই।
সেই রাতে সাফওয়ান ভয় পেয়ে কাঁদে — "রোজ, আমি আর পারছি না। এই বাড়িতে কিছু আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি… তারা তাকিয়ে থাকে… দেয়ালের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকে…
রোজ তাকে শান্ত করে। কিন্তু ঠিক তখনই, জানালার পাশে দাঁড়ানো সেই মেয়েটাকে দেখে—লাল শাড়ি, চুল এলোমেলো, মুখ নেই, শুধু গর্ত। আর একটা মরা পাখির মতো কণ্ঠে বলে, “তুমি শেষ… এবার তুমি... আমার
সেই রাতে কফিন নিজে থেকে খুলে যায়। ভেতর থেকে উঠে আসে কিছু — শরীর মানুষের মতো, কিন্তু চোখগুলো একদম ফাঁকা। মুখহীন সেই আত্মা এগিয়ে আসে।
রোজ আর সাফওয়ান পালাতে চায়, কিন্তু দরজা বন্ধ।
আত্মা গর্জে ওঠে, আর এক ঝাপটায় সাফওয়ানকে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলে। রোজ চিৎকার করে ওঠে — "তোমার কী চাও?!"
কণ্ঠস্বর দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়:
“আমি শুধু সত্য চেয়েছিলাম… আমি শুধু চাই কেউ জানুক, কীভাবে তারা আমাকে পুড়ে মারল… ত্যাগ করল…”
রোজ বুঝতে পারে — এই আত্মা আসলে একজন নারী, যাকে বহু বছর আগে এ বাড়ির পুরুষরা ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে জীবন্ত কফিনে বন্দী করেছিল। কারণ সে সত্য জানত — এ বাড়ির পুরুষেরা কীভাবে মেয়েদের নিগ্রহ করত, আর তারপর মেরে ফেলত।
সেই নারীর নাম ছিল — মায়া
(সত্যের মুক্তি)
রোজ বাবার ডায়েরি পড়ে বুঝে যায় — তার বাবা আসলে মায়ারই ভাই ছিল। সে ছোটবেলায় দেখেছিল, কীভাবে দাদাদের হাতে তার বোন মায়া মরেছিল। সেই সত্য চাপা দিতে বহু বছর পর বাবাও নিরব ছিলেন।
কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি অনুতপ্ত হয়ে সব তথ্য রেখে যান রোজের জন্য।
রোজ চিৎকার করে ওঠে:
“মায়া, আমি তোমার সত্য সবাইকে জানাবো! আমি কিছুই লুকাবো না! আমাকে দয়া করে বাঁচাও!”
ভূতের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। বাতাস থেমে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস — “তবে মুক্তি চাও তো, তবে দাও… রক্ত নয়, দাও আত্মা।”
রোজ বোঝে, একমাত্র উপায় — নিজের আত্মাকে উৎসর্গ করে সত্য প্রকাশ করা। সে কাঁপা গলায় বলে, “ঠিক আছে।”
তারপর সে বাবার ডায়েরি, মায়ার কঙ্কাল, আর সমস্ত প্রমাণ দিয়ে লেখে একটা রিপোর্ট। স্থানীয় থানায় পাঠায়। পত্রিকায় ছাপা হয় — “বনগ্রামের কালঘরে নারী হত্যার ভয়াবহ ইতিহাস উন্মোচিত”।
আজকের দিনে, কালঘরকে ঘিরে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে।
রোজ, হাসপাতালে ভর্তি — স্নায়বিক ভেঙে পড়া অবস্থায়, অর্ধেক প্যারালাইজড। সে কথা বলতে পারে না, কেবল মাঝে মাঝে বলে — “সে এখন ঘুমিয়ে আছে... কিন্তু আরেকবার জাগলে কেউ বাঁচবে না…”
সাফওয়ান? নিখোঁজ। আর ফিরে আসেনি।
বাড়ির নিচে এখনো আছে সেই কফিন — যার মুখ বন্ধ, কিন্তু মাঝেমধ্যে ভেতর থেকে টোকা পড়ে…
টক… টক… টক…