
পর্ব- ৫: পরদেশী মেঘ রে
আমাকে দেখে হাসিমুখে একজন কিশোরী এগিয়ে আসলো। কথা বললে বুঝলাম তার সাথেই ফোনে কথা হয়েছে গতকাল। বাকি পরিচয় শেষ করে সসঙ্কোচে তার বোনের খবর জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে আরেকটু হাসলো প্রথমে।
ভয় পাইয়েন না, ভাইয়া। আগে চলেন, হাতমুখ ধুয়ে কিছু খাবেন।
কোথায়? তোমাদের বাসায় যাইতে পারবো না, ভুলেও না। তার চেয়ে কোন একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায়।
মা আপনার জন্যে রান্না করে বসে আছে। আপনি বাইরে খাইলে আমার কপালেও খাবার জুটবে না। আমার মা কিন্তু খুবই কড়া।
এইবার তার অট্টহাসি। কী বিপদে পড়লাম - ভাবতে গিয়েই আবার মনে হল এই সুযোগে যদি ওর পরিবারকে চেনা হয়ে যায় মন্দ কী? কিন্তু মাথা নেড়ে কঠিন প্রতীজ্ঞায় না বললাম।
ঐ তো একটা খাওয়ার হোটেল দেখা যায়। আমি জাস্ট যাবো আর আসবো।
মেয়েটাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একমনে হাঁটতে শুরু করলাম। লজ্জা, ভয়, সংকোচ অথবা উৎকণ্ঠা- যেকোনো একটা অনুভূতি এসে আমার পুরো দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে জমিনে।
ঐদিন আমি আর রাজশাহীতে ফিরতে পারি নাই। এবং সন্ধ্যায় মেয়েটার দাওয়াত আর এড়াতে পারলাম না। নাশতা খাওয়ার উসিলায় একবার যেতেই হলো ওদের বাড়ি। দোকান থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। মাঝখানে একটা শুকনা ডোবা, ঘুরে পাড় হতে হয়। এরপর ইট বিছানো সরু পথ সোজা ওদের বসার ঘরের দরজায় গিয়ে থেমেছে। সেখানেই ওর সাথে আমার এক জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো দেখা হলো।
আহারে, কী মলিন হয়ে গেছে মুখটা। যমুনার পাড়ে দেখা মানুষটার সাথে আকাশ পাতাল ফারাক। চুল এলোমেলো। মলিন কুঁচকে যাওয়া সুতির ওড়না একদম হাত ঢেকে জড়ানো। ‘কেমন আছেন’- এই একটা প্রশ্ন করেই নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে চলে গেলো।
আমি নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। গত দেড় মাসে আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে। প্রতি কলের শুরুতে ওকে আনন্দে আত্মহারা মনে হতো, ফোন রাখার সময় পুরাই বিপরীত। মলিন একটা “আচ্ছা, রাখি তাইলে” বলতে বলতে সে নিভে যেতো জ্বালানি ফুরানো প্রদীপের মতো। আমিও বারবার একটা অচেনা শূন্যতা নিয়ে ঘরে ফিরতাম। আরেকবার আলাপের অপেক্ষায় আমি মনে মনে মাতাল। কথা বলার এই প্রবল নেশার নাম দিয়েছিলাম “কণ্ঠপিপাসা”। অনিবার্য তৃষ্ণার ভার আমি নির্বিবাদে মেনেও নিলাম। হৃদয়ের আদান প্রদান ছাড়া, প্রতিশ্রুতি আশ্বাসবিহীন জমে উঠতে থাকা প্রেম আবহে দিনরাত বলতে গেলে ভালোই কাটছিলো। প্রতিদিন ডাইরির পাতায় চিঠি লিখছি। নদীর পাড়ে, কলেজের বারান্দায় হেঁটে বসে দাঁড়িয়ে - সদা তৃষ্ণার্ত আমি বহু রঙের স্বপ্ন রচনা করছি, প্রতিনিয়ত। একদিনের কল্পনার আড়ালে আরেকদিনের ভাবনাগুলো হাসিমুখে তলিয়ে যাচ্ছে।
এরপর একদিন নিয়মিত কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল খুবই তুচ্ছ অজুহাতে। আমি নাকি ওর প্রতিদিনের রুটিন নষ্ট করে দিচ্ছি। পড়াশোনারও ক্ষতি হচ্ছে খুব। শুনে বুকটা দুই ভাগ হয়ে গেলেও কোন বিবাদ প্রতিবাদ না করে বললাম তাহলে সপ্তাহে একবার করে কথা হোক।
আচ্ছা, তাইলে রাখি।
ফোন রাখার পর মনে হলো আজকে ওর মোহনীয় আওয়াজের বদলে আমিই ক্রমশ নিভে যাচ্ছি। ঘরে ফিরে ডাইরি খুলে বসলাম। প্রতিদিন কথা না হলে, কী আর এমন ক্ষতি? ডাইরির পাতায় লেখা চিঠিগুলো না হয় একটু দীর্ঘতর হবে। আমার কল্পনার পরিধিও হয়তো বাড়বে এবার। নানা রকম সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে। তাছাড়া শহর উপশহর ঘুরে গান সংগ্রহের নতুন নেশা আমাকে খুব সহজেই প্রতিদিন কথা বলতে না পারার শোক ভুলিয়ে দিল।
শুধু চায়ের কথা বলে আজকের সন্ধ্যায় ডেকে আনা হলেও, আমাকে বের হতে হলো একেবারে রাতের খাবার খেয়ে। ওর মাকে আমার অদ্ভুত ভালো লাগল। ঠিক আমাদের মায়ের মতো না। শুনেছি অল্প বয়সে নাটকের দলে কাজ করতেন। বাচনভঙ্গি মনে রাখার মতো সুন্দর। আমাকে অপ্রত্যাশিত যত্নে আদর করে পোলাও, মাংস, পিঠা খাওয়ালেন। আর পুরোটা সময় দুই মেয়েকে নিয়ে গর্বের কাহিনী বললেন একটার পর একটা। টিভিতে রাত আটটার খবর চলছিল। হঠাৎ কথা থামিয়ে মনোযোগ দিয়ে একটা দুঃসংবাদ শুনলেন। আমাদেরকেও ইশারায় মনোযোগ দিতে বললেন। “গানের কোকিল” খ্যাত আমাদের একজন মহান গায়িকা মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁর বড় বোনও অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। দুই তিন বছর আগে সর্বনাশা ক্যান্সার তাঁকেও কেড়ে নিয়েছে। ঢাকার ডাক্তারেরা এই অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় গায়িকার আরোগ্যের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না। খাবার টেবিলে বসা আমাদের অসহায় চোখগুলো মুহূর্তেই অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। খবর শেষে সেই কোটি হৃদয় জয় করা শিল্পীর গান ভেসে এলো কানে।
তবুও তো ফোটে ফুল পাখি গান গায়
ভাবে না তো কেউ তারে চায় কি না চায়
ফুলের প্রাণে পাখির গানে
কতো না আশা রয় অগোচরে
একেকটা শব্দের উচ্চারণে রীতিমতো মধু ঝরছে। চার দশক ধরে এদেশের গ্রাম শহরের সর্বস্তরের জনগণ তার গায়কির মোহে বুঁদ হয়ে কতো ছবি এঁকেছে মনের চোখে! কত শত বার তাঁর গানের চরণ কাগজে লিখে ভালোবাসার আদান প্রদান করেছে সহস্র তরুণ মন। আমার নিভে যাওয়া মন আরো একবার ঘন বর্ষায় তলিয়ে গেল। অসুস্থ শিল্পীর কালজয়ী কণ্ঠ টানা বাজছে দেশের সবগুলো চ্যানেলে। বুঝলাম এই মধুকণ্ঠ হারিয়ে ফেলার ভয় শুধু এই ঘরে বসা চারটা মানুষের না, পুরো জাতি আসন্ন শোক কল্পনা করে স্তব্ধ। আমাদের সম্মিলিত বিষাদ স্রোতে আজকে তিনি স্থির পদ্ম। খানিক পর একটা চ্যানেলে দেখলাম তিনি গাইছেন তাঁর সমসাময়িক আরেক বিস্ময়কর গায়িকার গান। শুভ্র শাড়ির আঁচল উড়িয়ে কাশবনের পাশে বসে আছেন, আর চঞ্চল মেঘগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে পর্দায় ঝুলে থাকা উদাস আকাশে।
ওগো মেঘ তুমি এতো জোরে এসো না
ঝড় হয়ে শেষে ঘুম ভেঙে দিও না
ঘুম ভেঙে গেলে সে তো কাছে রবে না
না বলা কথা আর বলা হবে না
আমার না বলা কথা লিখে সাজানো ডাইরিটা মনে পড়ে গেলো। দুইবার ছোট বাক্যের কুশল বিনিময়ের বাইরে সামনাসামনি আমাদের আর কোনো কথা হয় নাই আজ, এখন পর্যন্ত। ডাইরিটা সাথে করে নিয়ে আসা উচিত ছিল। পড়ে না শোনাতে পারলেও অন্তত ওর হাতে দিয়ে চলে যেতে পারতাম। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে অন্য একটা বাড়িতে। মনভর্তি আফসোস নিয়ে খাওয়ার পর সেইদিকেই হাঁটছি, পেছনে কখন ছোট বোনকে সরিয়ে ও এসে পা মেলাচ্ছে টের পাই নাই। দোকানের আগের মোড়টা আবছা অন্ধকার, একটু ভুতুড়ে। ছমছমে গা নিয়ে অগত্যা ঘুরে তাকাতে হলো পিছিয়ে পড়া পথপ্রদর্শকের দিকে।
তুমি কখন বের হলা? তোমার বোন কই? আমি কিছু ভুল দেখতেছি না তো ?
এবারও কোনো কথা নাই ওর মুখে। আরও একটু অন্ধকারে ডুবে গিয়ে বরং আমার চোখে চোখ রাখলো, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় কেটে গেলো আমাদের অন্ধকারে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। তারপর ওর উচ্চারিত পয়লা বাক্য টাকে মনে হলো দোনলা বন্দুকের গুলি। রাগ অভিযোগের ধারালো তির ছুঁড়ে আমাকে ঘায়েল করতে তার এক মিনিটও লাগলো না।
আপনাকে আমি এখনও সবসময় “আপনি” বলি কেন?
তাইতো, এই প্রশ্ন আমার মাথায় আগে না আসা সত্যিই অপরাধ। বয়সে আমরা প্রায় সমান। তাহলে ফোনে এতো এতো বার কথা হয়েছে, কখনো ওকে আমি “তুমি” ডাকার অনুরোধ করি নাই কেন? কোন অজুহাতেই এই বিশাল উদাসীনতার দায় এড়ানো যায় না। আমি দুই হাতে তার মুখটা তুলে নিজের নিঃশ্বাসের আরো কাছে নিয়ে আসলাম। টিভির পর্দার মতো আমাদের আকাশেও তুলট মেঘ থাকলে ভালো হতো। আর এই শহরটা যদি এখন যমুনার চরের মতো জনহীন হয়ে যেতো! ওর অভিমানগুলো হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে বলতাম পুরো দুনিয়া ভুলে তুমি শুধু আমার বুকে, আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকো।
পরদেশী মেঘ রে আর কোথা যাসনে
বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দে ছায়া তারে
বন্ধু ঘুমায় রে
আয়রে মেঘ আয়রে
চলবে…