Posts

গল্প

দুই এক্কে এক !

July 5, 2025

Ehsan Samad

130
View

বৈশাখ মাসের আজকের আকাশের অবস্থা দেখে কে বলবে যেআধাঘন্টার মধ্যে এমন দানব হয়ে যাবে! অবশ্য বছরের এই সময়টার ভরসানাই। আচানক ভোল পাল্টায়। সিএনজিতে বসে কাজল তিনদিকে তাকালো। বামে আর ডানে; দেখেনিলো পর্দা আছে কিনা। বৃষ্টি যদি জোরেশোরে নামে ঢেকে দিতে হবে তো । সেজেগুজে বের হয়েছে কাজল একটা ইফতারির দাওয়াত এর জন্য। নাইলেদেখা যাবে কাকভেজা হয়ে হাজির হতে হয়েছে দাওয়াতে। আর  শেষেতাকালো উপরের দিকে। গতবছর যা শিক্ষাটাই নাহলো ! উপরে পর্দা কেটে নতুন কেনা মোবাইল-টা টান দিয়েনিয়ে ভেগেছে ছিনতাইকারি-টা। আর মরার উপরখাড়ার ঘা হইলো সেইমোবাইল আবার কেনা ছিল ক্রেডিট কার্ডের ইএমআই দিয়ে। আরো বছর দুয়েক মাসে মাসে কিস্তি দিতে হবে। পাখি গেল উউড়া মাগার পালক রইছে পইড়া টাইপ অবস্থা। সেই আফসোস ভরা স্মৃতি মনে পড়তেই তার প্রিয়একটা গালি দিতে যাচ্ছিল আবার কাজল। “নাহ নাহ থুক্কু নাউজুবুল্লিাহ…রোজা রেখে মুখ খারাপ করা যাবে না”…স্বগতোক্তি করে ফেললো। 

কাজল ইফতারিতে যাচ্ছে একটা বড়সড় হোটেলে। অফিসিয়াল দাওয়াত তো...যেতে ভালোই লাগে। কতজনের সাথে দেখা হয়ে যায় এক ছাদের নিচে।হাহাহিহি করে ভালোই সময় পার হয়। আর নতুন নতুনএকটা শব্দ শিখেছে কাজল। চান্স পেলেই ঝেড়ে দিচ্ছে এখানে ওখানে। নেটওয়ার্কি ! নতুন কারো সাথে দেখা হওয়াই নাকি নেটওয়ার্কিং, সেখান থেকে জায়গামত কানেক্ট করা নাকি আরো বড় নেটওয়ার্কিং। এরেচিনি, উনি আমারে চিনে এগুলি বলার মত পায়ের নিচেমাটি শক্ত হওয়াটাও নেটওয়ার্কি। সুতরা্ং মানিব্যাগ ভর্তি ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বের হতে এখন আর ভুল হয়না কাজল-এর। 

অবশ্য কাজল কে দোষ দেয়া যায় না ! মফস্বলের পোলা..ছিল আলাভোলা। এতো কিছু তো আর দেখাহয় নাই এই আধুনিক সমাজব্যবস্থার। অভাবের সংসারে টানাটানি তো ছিলই। বাপ-মা অল্প বয়সেমারা গেল বুক আর চারপাশের বাস্তবতাদুটাকেই ভারী করে। পড়ালেখা শেষ করতেই তো লেগে গেললম্বা সময় অনেকটা। তাই এখন খুব আগ্রহ নিয়ে এইসব ফলো করে। জীবন দর্শন নিয়ে দুই চার পাতা পড়তে গেলে অবশ্য হাসি আসে সময় সময়। আশে পাশে অনেকের অনেক কিছু হয়ে যাবার অস্থিরতা সপ্তাহের তিন রাত যেমন কাজল কে অস্থির করে, মিরার সাথে রাতের ভাত খেয়ে জয় গোস্বামির কবিতার লাইন থেকে যখন আউড়ায়, ‍“পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবনকাটাব পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন‍‌‌“; তখন বাকি চার রাত আবার এই দর্শন নিয়েবালিশে ঘুম পাড়ায়, “ধুরো, ধীর স্থির জীবন শেষে চুপে চাপে সটকে পড়াটাই সহজ হবে”।

এটা মিরা তাকে সময় সময় খালি মনে করিয়ে দেয়। ও মিরার কথাএলো যখন, তখন একটু পিছনের দিকে গিয়ে আবার আজকের বিকেলে আসি। মিরা কাজল-এর স্ত্রী। সাড়েতিন বছর হলো প্রায় বিয়ের বয়স। মিরার সাথে বিয়ের ঘটকালি করে দিয়েছিলো কাজল-এর এলাকার দোকানদারতাইজুর। রোজ রাতে তাইজুর এর পাশের দোকানথেকে রাতের তরকারি কিনতো কাজল, ভাত-টা নিজেই রান্না করে নিতে জানে সে। এরপর যাহয় আরকি... কি করেন কইথাকেন এইসব ধুনধুন আলাপ শুরু হয়ে চা, বিড়ি খেতে খেতে তাইজুর বলে বসলো, ‍"‍‌ভাইজান, বিয়া বসেন। পরিচিত ভালো মাইয়া আছে। এলাকার এক মুরব্বীর ছোটমাইয়া। পড়ালেখা শেষ। আংকেল-ও পোলা খুঁজতাছে। আলাপ করায়েদেই আংকেল এর সাথে...পরেযদি থাকে নসিবে, আপনে আপনে আসিবে।‍“ 
 

তাইজুর লোকটা বেশ ভালো রসিক আর গপ্পোবাজ ছিলো।তাই কাজল রাতে বেশ আড্ডা দিতো সারদিনের পর একটু হালকামেজাজ ফিরে পেতে। পরে আসলেই সেই আলাপ গড়িয়ে মিরার বাসায় রাজি হয়ে ছোটখাটো আয়োজনে বিয়েটা হয়েই গেল। 


কাজল এর চোখে মিরাদুনিয়ার নবম আশ্চর্য, অষ্টম আশ্চর্য সে এখনো নিজেকেইমনে করে। মিরাকে তার এমন আশ্চর্যজনক মনে হওয়ার অনেক গুলি কারণ সে নিজে নিজেভেবে বের করেছে। কয়েকটা এরকম; মিরা সুন্দরী না আবার অসুন্দরীওনা, মিরা রাগী না আবার একটুযে বদমেজাজী না এমনও না, চাহিদার লিস্ট কখনোই লম্বা না কিন্তু সময়সময় মুখের উপর বলে দিয়ে শোনায় এটা লাগবে মানে লাগবেই, মাঝে মাঝে চুপ করে খালি শোনে আবার কোন কোনদিন কথার ট্রেন এর কোন ইষ্টিশনেথামার লক্ষণই থাকে না। কাজল খুব মজা পায় বিষয়টায়। প্রথমদিকে বিরক্তির শেষ ছিল না তার। ইহাকোন প্রকারের মানবপ্রকৃতি...বড়ই বিচিত্র ! 

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল বিয়ের পরের বেশ কিছু সময়। দুজনের সংসারে সবকিছু মিলিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলে যায় দুজনের। কিছু শখ মিটে যায়, কিছু তুলে রেখে দিয়েছে আগামীর সুদিনের অপেক্ষায়। খারাপ কি ! 

প্যা…প্যা…প্যা। টানা হর্ণ শুনে কাজল-এর মাথা ধরেগেছে রাস্তায়। কাছেই চলে এসেছে হোটেলের। আর দুই সিগন্যালপার হলেই মনে হচ্ছে পৌছে যাবে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে আজকে ছোলা, পিয়াজু, বেগুণী টাইপ রেগুলার কোন মেনুর দিকে ফিরেও তাকাবে না। এগুলি তো ডেইলি পাড়ারমোড়ের দোকান থেকে নিয়ে বাসায় ইফতার করা যায়। ল্যাম্ব, বড় বড় চিংড়ি, ষ্টেক এগুলি দিয়ে প্লেট আর পেট বোঝাই করতে হবে আজকে। ও আর হ্যা….খালি ঝোলা ভরতে গিয়ে আবার নেটওয়ার্কিং-টা একেবারে মিসকরা যাবে না !

এই তো চলেএসেছে হোটেলে। লিফট-এ উঠে হলরুমে যেতে হবে। আয়নায়নিজের পান্জাবি-টার দিকে তাকালো কাজল। নাহ ঠিক আছে…মিরা জিনিসটা খারাপ কিনে নাই। বড় হলরুমে ঢুকতেইদেখা হয়ে গেল এক জন পরিচিতমানুষের সাথে। 
‍‍"আরে ভাই, চলে এসেছেন...good ! কেমন আছেন?” 

“চলে যাচ্ছে রুবেল ভাই , সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।“

চক্কর দিয়ে দিয়ে দেখা করে ফেললো বেশ কয়েকজনের সাথে। বাহ ভালো হয়েছে....কয়েকজনের সাথে সামনা সামনি দেখা করার বেশ ইচ্ছা ছিল কাজল-এর। এসব যোগাযোগ রাখার বুদ্ধি দেয় তার অফিসের এক সহকর্মী। বলতেথাকে, ‍‍“আরে মিয়া, এক চেয়ার আরকত গরম করবেন ! জায়গা বদলাইতে হবে না ! তখন যদি বাইরে ভাই-বেরাদার না থাকে কারেকইবেন আবদার কইরা ? ঈদে চান্দে হাই হ্যালো করলে মনের আড়াল হইবেন না যদি চোখের আড়াল হইয়াও যান।“

বেটা বলে কি ! এইসব চিকন বুদ্ধি তো এমনি এমনিআসতো না কাজল এরকখনোই। তাই মোটামুটি সমীহ করেই শুনে উপদেশগুলি। আসলেই যদি লাগে সেদিন দেখা যাবে কে ভাই বেরাদারহইলো। 

নাহ আর বেশি সময়নেই…ঘড়ি উলটে দেখে নিয়েছে। একটা টেবিলে বসে পড়লো কাজল। টেবিলে প্লেট সাজিয়ে দিয়েছে বেশ কিছু আইটেম দিয়ে। পরে লাগলে আরো নিয়ে নিবে। খাবারের অভাব নেই। দামি দামি মেনু দিয়ে ভরা। অনেকের চোখ দেখলে বোঝা যায় পেটের ক্ষিধা মিটাতে গিয়ে চোখের ক্ষিধা দমিয়ে রাখতে পারেনি…শেষে প্লেটে খাবার নষ্ট করেছে গাদাখানেক !

প্রোগ্রাম শেষে আর দেরি করেনিকাজল। ফিরতি পথ ধরে জলদিবাসায় চলে এসেছে। চা মিরার সাথেইবাসায় বসে খাবে ঠিক করেছে। তাই ঘরে ঢুকে বলতেই মিরা তড়িঘড়ি করে চা বানিয়ে দিয়েছে।পাশে বসে  জিজ্ঞেস করলো, “কেমন হলো আজকের খাওয়া দাওয়া?” 

কাজল টিস্যুতে মোড়ানো দুটো মেডজুল খেজুর এগিয়ে দিয়ে বললো, “ভালো”। 

মিরার বানানোচা দারুণ হয়। কাজল আরেকটা চুমুক দিয়ে তাকিয়ে দেখলো মিরাকে আর হাসতে হাসতেইবললো, 
“কি ব্যাপার ! খেজুর তো ঝাল না…মিরা, তুমি কান্দো ক্যান ?” 

#নোট: ঈদ সংকলন ২০২৫ (আজব প্রকাশ)-এ প্রকাশিত হয়েছিল খুদে গল্পটি। 

Comments

    Please login to post comment. Login