পোস্টস

সমালোচনা

বাংলা সাহিত্যে বৈদেশী: বোরহারউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের দুনিয়া

২৫ মে ২০২৪

মানস চৌধুরী

এটা কোনো ইতিহাস-রচনা নয়: কৈফিয়ৎ
এটা কোনো ইতিহাস-রচনা নয়। টীকা বলতে চাইলে বলুন। নতুন কোনো বড় রচনার প্রারম্ভিক ভাবতে চাইলে ভাবুন। আমার জন্য আপাতত স্রেফ এক টুকরা রচনাই। এই টুকরাটি লিখতে গিয়ে, ল্যাপটপে নেট আছেই যেহেতু, গুগলালাম। দেখি যে বাংলা সাহিত্যে অবাঙালি চরিত্র নামে একটা বই আছে, রাজদীপ দত্ত ও স্বপন বর্মণ সহসম্পাদিত, দে’জ প্রকাশিত। বাংলাদেশে গোটা তিনেক পোর্টাল তা বিক্রিও করছে। আর কোথাওই তার প্রকাশসন দেয়া নেই। থাকলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। আমি এমন লোক নই যে ‘হায় হায় এত বছরে জানতাম না’ আক্ষেপ করতে বসব। আপনাদের জানানো এই কারণে যে তা কর্তব্য মনে হলো। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কথাসাহিত্য (কোন ব্যাটা যে এটার নাম দিয়েছিল কথাসাহিত্য তাঁকে সামনে এনে দিন; আস্তে করে উঠে অন্যদিকে গিয়ে বসব) যে আমি ফালাফালা করে পড়ে ফেলেছি তা দাবি করব না। তবে নিতান্ত গোগ্রাসে পড়ার কাল ছিল একদা। তাঁর পাণ্ডিত্যলোভী ও বিদ্যা-প্রকাশনাকাতর সকল শিক্ষার্থীর তুলনায় তো মারাত্মক বেশি বটেই, এমনকি সাধারণভাবে ঢাকা শহরের আনাচ-কানাচ খোঁজারু পাঠকদের তুলনায়ও বেশি বলতে পারি সম্ভবত। কিন্তু আমি এই রচনার মাধ্যমে (বা আগামীতে কিছু লিখলেও) জাহাঙ্গীর-এক্সপার্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশের সাধ করি না। বস্তুত এই ‘বিষয়ে’ এক্সপার্টিজের ঢাকাতে কোনো মূল্যও নাই।
 
আমার জীবনে জাহাঙ্গীর
যদ্দুর মনে পড়ে আমার জীবনে জাহাঙ্গীরের আগমন ঘটে দুইভাবে, এমনকি তিনভাবে। নিরীখ করে গুণলে চারভাবেও বলা যায়। বাক্যটা লিখে ফেলবার পর মনে হলো আসলে পাঁচ বা ছয়ভাবে বললেও ভুল হিসাব বা অত্যুক্তি হবে না। প্রত্যেকটা আগমনের সময় আমি পরের আগমন/গুলোর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত থাকিনি, থাকতাম না। অবশ্য জগতে কেই-বা ভবিষ্যতের ঘটনা-মটনা জেনে থাকেন! তারপরও এটা বলা জরুরি যে, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়কালে আমি যে পরীক্ষার বইগুলোর বাইরের তামাম বই পড়ে ফেলতে চাইতাম, মায় এমনকি প্রতিবেশীর বাড়িতে থাকা বিচিত্রার ঈদসংখ্যা, সিনেমা-পত্রিকা, বাসায় থাকা পুরান পঞ্জিকা, বাদামের ঠোঙা, দেয়ালের ছাগল-খাওয়া আধা পোস্টার ইত্যাদি সেই সময়কালের মধ্যে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়তে পারার আগে একদা কোনো এক ঈদসংখ্যাতে আর পাবলিক লাইব্রেরির তাকে যথাক্রমে ‘হাতে রক্তের দাগ’ আর ‘মুণ্ডহীন মহারাজ’ পেয়ে যাই। প্রথমটা একটা গল্প যা, আমার পরিষ্কার মনে আছে (বহু পরিষ্কার মনে-থাকাও ভুলভাবে মনে থাকে এই দুনিয়ায়) ঈদসংখ্যাতে উপন্যাস ক্যাটেগরিতে ছাপা ছিল। দ্বিতীয়টা একটা গল্পগ্রন্থ। এখন কোনটাকে প্রথম পাই তা আর মনে নাই। প্রথম ‘কথাসাহিত্য’ পাঠ করেই আমি তাঁর অকথ্য রকমের গ্রাহক হয়ে পড়ি। অকথ্য কারণ তাঁকে পাঠ করা আমার তৎকালীন নাবালক মার্ক্সবাদী মাথাতে নানাবিধ বেদনা ও উদ্ভাসের আচার খাইয়ে এক দুরারোগ্য ব্যাধির মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এর অন্তত বছর খানেক পরেই হবে যে আমি ক্লাসরুমে তাঁকে পাই। এই লোক যে সেই লোক সেটা বুঝতেও কদিন লেগেছিল। এগুলোর নিখুঁত হিসাব-নিকাশ আর মনে নাই। 
 
বাংলা সাহিত্যে বৈদেশী
আমি গুণতে বসিনি। কিন্তু সাধারণভাবে কখনোই আমার মনে হয় নাই বাংলা ‘কথাসাহিত্যে’ বিদেশীরা বিশেষ জায়গা করতে পেরেছেন। এমনকি ‘স্বদেশী’ আর ‘উপমহাদেশীয়’ অন্যান্য জাতির লোকজনও যে বিশেষ আমলে এসেছেন তা মনে হয় নাই। সেদিক থেকে বঙ্গদেশের/বঙ্গসমূহের রচনাকারেরা নিবিষ্ট একদেশদর্শী বলা যায়। এমনকি হো হা হা হা করে হাসিদার খলনায়ক আমদানি করার বেলায়ও এঁরা কার্পণ্য দেখিয়েছেন। সেদিক থেকে আসলেও চলতি ধারার ছায়াছবির দিকদর্শন প্রসারিত। এখানে হলিউডেই কেবল সাবেক সোভিয়েত ও অল্পসাবেক আফগান খলনায়কদের হাজির করে থাকে তা নয় (হো হা হা হাসি ব্যতিরেকে), মুম্বই থেকে এমনকি ঢাকার প্রডাক্টেও ‘দেশের শত্রু’কে বিদেশী হিসাবে পাওয়া যায়। যাকগে, সে আরেক আলাপ। 
 
মোটের উপর রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ আর প্রমথ চৌধুরীর ‘ফুলের মূল্য’ গল্পটির ওই বিলাতি মেয়েটি ছাড়া আমার একবার চিন্তা করে মনেই পড়তে চায় না আর কাউকে। তবে তা নিতান্তই আমার অল্পপাঠের দোষের কারণেই হবে। না তাও নয়, আরেকটু আমারও পড়ে। সুবোধ ঘোষের ওই ইরানি ফেরিওয়ালিটিও (সারা) মনের মধ্যে বেদনার এক সূক্ষ্ম বিন্দু হিসাবে মনে পড়ে যান (গল্পটার নাম ‘উচলে চড়িনু’)। ছড়ানো ছিটানো টুকরা টাকরা সুনীল গাঙ্গুলির দুচারজনও আছেন বলেই এখন মনে হলো।   
 
জাহাঙ্গীরের বিদেশিরা 
আমার প্রথম পড়া ‘হাতে রক্তের দাগ’ হোক কিংবা মুণ্ডহীন মহারাজ হোক, বিদেশি পেয়েছিলাম দুই ক্ষেত্রেই। জাহাঙ্গীরের বিদেশিরা বাংলাদেশে ফেরি করতে আসেনি। তাঁর সময়কালে সেটা সহজও ছিল না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা জাহাঙ্গীরের গল্পবলিয়ে কর্তা ঘুরে বেড়ায়, দেশান্তরে – ‘দূরদূরান্ত’ অবধি। ‘হাতে রক্তের দাগ’ গল্পের নায়ক কিংবা গল্পবলিয়ে কর্তা (দুটোই এক পুরুষ কিনা মনে নেই, এখন দেখব না খুঁজে) উগান্ডার ‘পলাতক’ বিপ্লবী (তাঁর নামও খুঁজে দেখব না, যা মনে আছে তার ভিত্তিতেই লিখব)। ‘রিমি তোমার জন্য’ গল্পে আছেন পূর্বজার্মানির বিপ্লবী। সম্ভবত রিমি নিজেও (মনে করার জন্য পড়ে দেখব না) জার্মানিতে নিগৃহীত একজন। এইসব কাজ আর তাঁর ‘আন্তর্জাতিক’ মানুষজন সত্তরের পয়লাভাগ থেকেই বিকশিত। 
 
মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর সংগঠক ভূমিকার সাথে এই প্রবণতাকে পেঁচিয়ে-পুচিয়ে মিলিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু সেটা আমি করব না। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিউবার বিপ্লব, ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রাম, নন-এলায়েন্স/জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বেগবানতা এইসব বৈশ্বিক ঘটনা চিন্তা করলে ‘আন্তর্জাতিকতা’র ভ্রূণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে পেঁচিয়ে দেয়া আমার কাজ হবে না। বরং বেঁচে থাকলে, ১৯৯২-পরবর্তী আওয়ামীমনস্ক (অথচ আওয়ামী-শিবিরে বিশেষ অ/নি-গৃহীত) জাহাঙ্গীর নিজেই বুঝিয়ে দিতে পারতেন ভাল। তিনি বোঝালেই যে বাধ্য ছেলের/ছাত্রের মতো মেনে নিয়ে চলে আসতাম তাও নয়। এই কথা আমার অতিরঞ্জন নয়। তিনি আসলেও পরে মহাপৃথিবী বলে একটা এই কিসিমের উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু ওটা আমার বিবেচনা-অযোগ্য. মানে কিনা আমি বিবেচনা করিনি। 
 
তাঁর এই নানান দেশীয় বিপ্লবীদের গল্পে এসে হাজির হতে থাকার প্রক্রিয়াটি তাঁর ৫০ দশক থেকে সুগঠিত/সংগঠিত গভীর মার্ক্সবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদ থেকে উৎসারিত (বলে আমি দাবি জানাই)। পরের দুই দশকে জাহাঙ্গীরের উপলব্ধি আরও বিকশিত আরও প্রসারিত হয়েছে। তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক মার্ক্সবাদী তত্ত্বের মানুষজনের (ও তাঁদের কাজের) সন্নিকট হয়েছেন। এই উত্তর-ঔপনিবেশিক (বা প্রতি-সাম্রাজ্যবাদী, আরও গ্রহণযোগ্য পদে বললে) তাত্ত্বিকেরা বর্তমানের ‘ফেন্সি ভারতীয়’ তত্ত্বধারীরা নন। দক্ষিণ আমেরিকীয়, পাকিস্তানি, আফ্রিকীয় – ‘আন্তর্জাতিক’ভাবে বিন্যস্ত। জাহাঙ্গীর হলেন সেই বিরল দুর্ভাগা যিনি রাষ্ট্রপন্থী ও জাতীয়তাবাদীদের (বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাণ্ডারী ও জাতীয় কর্ণধার) কাছে নিন্দিত ছিলেন ‘মার্ক্সবাদী’ বলে; আর ‘মার্ক্স’বাদী রাজনৈতিক দলসমূহ ও বামপন্থী জ্ঞানকাণ্ডারীদের কাছে নিন্দিত ছিলেন ‘নয়া-মার্ক্সবাদী’ বলে। (আমি জানি না এই ‘কলঙ্ক’ মোচনের চেষ্টাতেই তিনি আওয়ামী ঈমানের পরীক্ষা দেবার চেষ্টাতে নেমেছিলেন কিনা, উত্তর কালে। আসলে আমার এই রূপান্তর নিয়ে বিশ্লেষণেরও আগ্রহ নাই।)      
 
‘আমাদের সময়’ তাঁর ৯০ দশকের গল্প। সম্ভবত গণতন্ত্রের প্রথম দিন ও অন্যান্য গল্প বইয়ে সন্নিবেশিত। নিবিড়ভাবে দেখলে এই গল্পটি ও এই বইয়ের অন্যান্য গল্প সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল রদবদলের পরে। এই গল্পের চরিত্রগুলো বিদেশি; বস্তুত এই গল্পে দেশিই বরং নাই। প্রথমস্বর/উত্তম-পুরুষে যিনি গল্পটাকে বলতে থাকেন সেই আব্রাহামও কোনো দেশি, এমনকি দেশস্থ, কণ্ঠ-সত্তা নন। তিনি ইংল্যান্ডে প্রোথিত। ওর বান্ধবীও তাই। তবে সেবামূলক কাজে নানান দেশে যেতে হয়। এ্যান একজন খ্রীষ্টানুসারী জনসেবিকা। গল্পটিতে একটা গুরুতর সন্ধ্যা আছে। বা সেই সন্ধ্যাই গল্প। সেটার আসর বসে প্যারিসে। সেখানে নিবাসেন মার্তা আর ওর বর/সাথি/পার্টনার (আমি নাম খুঁজবার জন্য বই বের করব না)। মার্তা একজন পেশাদার মডেল (ছিলেন)। মডেলদের সংগঠিত (ট্রেড ইউনিয়ন!) করার চেষ্টার কারণে তিনি ব্ল্যাকলিস্টেড হন, কাজ পান না আর। বাসাটিতে আর আসেন জানোস ও কাতিনকা। যথাক্রমে (হেটারোসেক্সুয়াল) বর ও বউ, সম্ভবত হাঙ্গেরি থেকে। অবশ্য জানোস ৮০র কাছাকাছি, কাতিনকাও ৭০-ঊর্ধ্ব; বরবউ ঠিক ব্যঞ্জনাতে মেলে না। মার্তাদের দাওয়াতে সকলে জড়ো হয়েছেন। সামান্য সান্ধ্য মদ্যযোগে নানান বয়সের মানুষদের এই মৃদু আড্ডটি ভালই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ জানোস বলে বসেন নতুন ঢেউয়ে কীভাবে তাঁর অফিস ঘরে তরুণ শিক্ষার্থীদের একদল ঢুকে পড়েন। তাকের বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেন। বলেন মার্ক্স আর লুকাস পড়ার দরকার নেই আর। সারা ঘর তছনছ করে বৃদ্ধকে তাঁর অপ্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। 
 
জানোস এই সন্ধ্যার আসরে কাঁদতে শুরু করেন। তিনি জানতে চান, যদি বিপ্লব পরবর্তী কালে কিছু লোক লোভী হয়েও থাকেন, তিনি কি একটা সৎ নিষ্ঠাবান শিক্ষকতা করে যাননি? কোনো অর্থ নেই তাঁর জীবনের, জীবনব্রতের? জানোসের কান্নাতে কাতিনকা কাছে এসে বসেন। তাঁর কাঁধে হাত রাখেন। অন্যরা কাঁদেন না তা ঠিক। কিন্তু কারো সন্ধ্যাই আর মাদকতা পায় না।       
 
গল্পটা সমাজতন্ত্র-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব-ইউরোপের যেন বা এক এপিটাফ!
 
যদি কখনো চুক্তিবদ্ধ বইটা শেষ না করতে পারি, তাও আপনারা জানবেন যে আমি একদা শুরু করেছিলাম এই নামে একটি বই (মানে অন্তত শুরু করব করব বলে ভেবেছি): The Forgotten ‘Internationalists’: Reading Jahangir and Others