Subtotal
0 ৳
Shipping and taxes calculated at checkout.
Continue Shopping →
ফিকশন
July 8, 2025
সায়মা শাহরিন
মহামান্য গ্রুহন ক্ষুব্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, তাঁর চোখে তখন ঝলসে ওঠা বিজলির মতো কঠোরতা। "শোন রুহাশ!" — কণ্ঠে ধমকের সাথে এক ধরনের হতাশাও মিশে গেল — "তুমি হচ্ছ আগামী দিনের সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানী, গ্রহ-পর্যবেক্ষণ পরিষদের গর্ব। আর আজ তুমি এমন অলৌকিক, ভিত্তিহীন কথা বলছ? এ যেন একেবারে বেমক্কা! তোমার মুখে এ ধরনের বক্তব্য আশা করিনি আমি। বিজ্ঞান কী তোমার কাছে শুধু অনুমান আর আবেগ?" তার প্রতিটি শব্দ যেন ধ্বনিত হচ্ছিল গ্রহমণ্ডলের প্রাচীন সভাকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে, রুহাশের কাঁপা মুখের সামনে অনিবার্য এক অন্ধকার ছায়া ফেলে। রুহাশ কাঁপা গলায়, চোখে আতঙ্ক আর বিশ্বাসের মিশ্র ছায়া নিয়ে বলল, “কিন্তু... কিন্তু আমি যা অনুভব করেছি, তা কী করে ভুল হতে পারে, মহামান্য? আমি তো নিজের চোখে দেখেছি—নিজের অস্তিত্বে টের পেয়েছি ওদের সংকেত... ওরা আসছে! ওরা নিঃসন্দেহে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে!” এক মুহূর্ত থেমে রুহাশ গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলল, “তারা আমাদের গ্রহের ঠিকানা জেনে গেছে, আর তারা একটা শক্তিশালী তরঙ্গ পাঠিয়েছে—অদ্ভুত এক কম্পন, যার ভেতর লুকিয়ে ছিল এমন এক ভাষা, এমন এক আকুতি, যা কেবল অনুভব করেই বোঝা যায়। আর আমি... আমি সেই তরঙ্গটিকে ডিকোড করেছি, আমাদের ভাষায় রূপান্তরিত করেছি।” তার গলা তখন কাঁপছে, কিন্তু চোখ জ্বলছে এক ধরনের আতঙ্কিত নির্ভরতায়। সে নিচু স্বরে বলে চলে, যেন কেউ শুনে ফেলবে এই গোপন বার্তা— “যা আমি পেয়েছি... যা আমি অনুভব করেছি, তা যদি আপনি নিজে একবারও অনুভব করেন, একবার অনুভুতি গ্রহণ করেন—তাহলে আপনি নিজেও নিশ্চয় বুঝবেন... তারা বন্ধুর মুখোশ পরে আসছে, কিন্তু অভিসন্ধি অন্ধকার... খুব অন্ধকার।” ঠিক তখনই সভাকক্ষের ভারী দরজাটি মৃদু এক ঘর্ষণের শব্দে খুলে গেল। অভিজাত পা ফেলে প্রবেশ করলেন মহামান্য হুকাস—পর্যবেক্ষণ পরিষদের প্রধান কৌশলবিদ ও জ্ঞানমণ্ডলের প্রবীণতম সদস্য। তাঁর প্রবেশে কক্ষের বাতাস যেন মুহূর্তে ভারী হয়ে উঠল, সমস্ত চোখ ঘুরে গেল তাঁর দিকে। তিনি চোখ মুছতে মুছতে, কিছুটা বিরক্ত গলায় বললেন, “কি নিয়ে এমন উত্তেজনা, গ্রুহন? সারা সভাকক্ষ তো তোলপাড় হয়ে উঠেছে! শুনি, কী ঘটছে?” মহামান্য গ্রুহন তখন যেন নিজের রাগ সামলে ঠাট্টার ঢঙে মুখে এক বাঁকা হাসি টেনে বললেন, “আহ, হুকাস! তুমি এলেই যেন মজাটা জমে উঠল! আমাদের তরুণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী রুহাশ আজ এক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন—বলছে, আমাদের গ্রহে নাকি মানবজাতি আসছে!” তিনি হালকা হেসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ! তারা নাকি এক ধরনের তরঙ্গ পাঠিয়েছে আমাদের দিকে, এক বার্তা—অন্তরে লুকোনো কোনো ভিনগ্রহী আকাঙ্ক্ষা! বুঝলে? এবং রুহাশ দাবি করছে যে সে সেই বার্তা আমাদের ভাষায় অনুবাদও করে ফেলেছে! কি মজার না?” তিনি হেসে উঠলেন—একটা শুষ্ক, কাঁটাযুক্ত হাসি, যেখানে অবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে বিদ্রূপ। মহামান্য গ্রুহন থামলেন না। তাঁর চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক, কণ্ঠে উপহাসের সুর আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। “বলো তো হুকাস,” তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “মানবসভ্যতা কি এতোটাই উন্নত হয়ে গেছে যে তারা প্রায় দুইশো মিলিয়ন আলোকবর্ষ পেরিয়ে আমাদের গ্রহের সন্ধান পেয়ে গেছে? শুধু তাই না, তারা নাকি আসছেও! হা হা হা!” তিনি হেসে কাঁধে হাত রাখলেন পাশের এক প্রবীণ সদস্যের, “আসলে অনেক দিন পর এমন করে হাসলাম। রুহাশের মতো তরুণদের কল্পনাশক্তি সত্যিই প্রশংসনীয়! এ যেন এক বৈজ্ঞানিক উপন্যাসের পাতায় থাকা কাহিনি!” কিন্তু ঠিক তখনই পরিবেশটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। মহামান্য হুকাস, যিনি এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে সব শুনছিলেন, এবার ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তাঁর কণ্ঠে কোনো বিদ্রূপ নেই—শুধু এক গভীর চিন্তার ভার। তিনি রুহাশের দিকে সোজা তাকিয়ে, ধীরে কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন, “রুহাশ... তুমি কি সত্যি বলছো?” একটা থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসে তিনি আবার বললেন, “নাকি এই সব কিছুই শুধু এক তরুণ মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক কল্পনা? আমার চোখে তাকিয়ে বলো—তোমার তথ্য সত্যি কি না। কারণ যদি সত্যি হয়... তবে আমরা এক ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি হতে চলেছি।” কক্ষটা নিস্তব্ধ। সময় যেন থমকে গেল। সবাই রুহাশের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার পরবর্তী কথার জন্য নিঃশ্বাস ধরে অপেক্ষা করছে। মহামান্য গ্রুহনের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। হুকাসের মুখে সেই গম্ভীর প্রশ্ন শুনে যেন তিনি একরকম অপমানিতই বোধ করলেন। তিনি হঠাৎ চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ গলায় বলে উঠলেন, “কি বলছেন আপনি, মহামান্য হুকাস? আপনি আমার কথা নয়, বরং একজন কিশোর গবেষকের আবেগঘন কল্পনাকেই বিশ্বাস করছেন? আমি তো কেবল যুক্তি দিয়েছি—আপনি তা-ও বিশ্বাস না করে ওর কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন?” কণ্ঠে রাগের সঙ্গে মিশে গেল এক বিন্দু অভিমান। কিন্তু হুকাস তাঁর দিকে সোজা তাকিয়ে ধীরে ধীরে তাঁর একটি বাহু তুললেন। সেখানকার আলোয় সেই নীলাভ ধাতব বাহুটা কেমন যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি নিঃশব্দে গ্রুহনের দিকে সেই বাহুটি তুলে থামার ইশারা করলেন—কোনো রাগ নয়, বরং এক স্নিগ্ধ অথচ অটল স্থিরতায়। “গ্রুহন,” হুকাস শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “এখন সময় হেসে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কখনো কখনো এক ফোঁটা সত্য পুরো এক সমুদ্রকে নাড়িয়ে দিতে পারে। চলমান ইতিহাসের ধারা বদলে দেয় আবেগ নয়, উপলব্ধি।” তিনি এবার রুহাশের দিকে তাকিয়ে, সভাকক্ষে আর কারো দিকে না চেয়ে বললেন, “তুমি বলো, রুহাশ। ভয় পেও না। সত্য যত ভয়ংকরই হোক, আমরা সেটা জানার জন্যই এখানে আছি।” চারপাশ নিস্তব্ধ। বাতাস থমকে গেছে যেন। তরুণ রুহাশের গলায় তখনো হালকা কাঁপুনি, কিন্তু চোখে আগুনের মতো এক দৃঢ় বিশ্বাস। রুহাশ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তার চোখে যেন আবছা এক ভয়, কিন্তু সেই ভয়ের পেছনে ছিল চরম এক আত্মবিশ্বাস। চারপাশের গুরুগম্ভীর বিজ্ঞানী, পরিষদের সিনিয়র সদস্য, আর দুই মহামান্য ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি তাকে কাঁপিয়ে দিলেও, সে তার অবস্থানে অটল রইল। সে কাঁপা গলায় বলল, “আপনারা আমার কথা বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। কিন্তু... আমি চাই আপনারা নিজেরাই অনুভব করুন। সেই তরঙ্গ... সেই বার্তা, যা আমি কেবল বিশ্লেষণ করিনি—আমি অনুভব করেছি… হৃদয়ের গভীরে।” সে এগিয়ে গিয়ে তার সিলভার ডেটা-প্যাডটি সংযুক্ত করল কক্ষের কেন্দ্রীয় সংকেত-প্রক্ষেপণ যন্ত্রে। কক্ষের আলো ম্লান হয়ে এল, আর একটি ধাতব শব্দে যন্ত্রটি চালু হয়ে উঠল। পরম মুহূর্তে, একটি অদ্ভুত কম্পন ধ্বনিত হল ঘরে—না কোনো ভাষা, না সংগীত, বরং এক ধরণের অনুভূতি। তারপর ভেসে উঠল এক শব্দ—স্বচ্ছ, অথচ কৃত্রিমভাবে মিশ্রিত এক কণ্ঠ। > "আমরা... মানব জাতি... আপনাদের কাছে এই তরঙ্গ পাঠিয়ে... অসীম আনন্দ পাচ্ছি..." "যদি আপনারা এই বার্তাটি শুনে থাকেন..." "... তবে বলে রাখছি..." "... আমরা মানব জাতি আসছি..." তারপরই, হঠাৎ করেই সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সংকেত থেমে গেল, যেন কেউ আচমকা ছেঁটে দিয়েছে সংযোগটি। যন্ত্রটি স্তব্ধ। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কেউ কিছু বলছে না। রুহাশ ধীরে বলল, “এটাই আমি পেয়েছিলাম। বাকিটা... আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।” মহামান্য হুকাসের মুখ হঠাৎ করে পাল্টে গেল। তাঁর ঠোঁট কঁপতে লাগল, চোখ খুলে গেল বিস্ময়ের পাশাপাশি গভীর আতঙ্কে। তিনি উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললেন, “না... না, এটা সম্ভব না!” কক্ষের সব সদস্য হঠাৎ কাঁপতে লাগল। তাদের মধ্যে একটা বিষাদের ছায়া নেমে এল। কেউ কেউ হাত মুড়ে মুখ চাপা দিল। হুকাসের ভয় যেন পুরো কক্ষে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু রুহাশ দমে যাওয়ার কোনো নাম নেই। তাঁর গলায় ভীতির পাশাপাশি এক অদম্য দৃঢ়তা ফুটে উঠল, “তাদের স্বাগতম জানাবো? মহামান্য, ভাবছেন যুদ্ধ করব? আমাদের তো যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই! আর যদি থাকতেও যেত, যুদ্ধ তো ভয়াবহ ব্যাপার—মানুষের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম কাজ। মানব জাতি যুদ্ধ করতে করতে নিজের গ্রহকে কতোবার ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা আমরা জানি।” সে একটু থামল, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “তারা শান্তি পছন্দ করে না, যদিও তারা নিজেদের ‘ভোকার কর্ড’ নামক তরঙ্গ মাধ্যমে বারংবার বলে—‘আমরা শান্তিপ্রিয়।’ কিন্তু কথার সঙ্গে কাজ মেলে না। এই ধরনের তরঙ্গের পেছনে লুকানো থাকে বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর পরাজয়ের ভয়। তাদের সেই ‘শান্তি’র কথা শুধুই বহিরঙ্গ।” “এখন তারা এই গ্রহ, হয়তো আরো অনেক গ্রহের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের আগমন নিয়ে আশঙ্কা না করলে চলবে না।” মহামান্য গ্রুহন আতঙ্কে গলায় কাঁপতে কাঁপতে মহামান্য হুকাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে... তার মানে... রুহাশ, সে কি আর কিছু বলতে পারবে না? আমাদের এই ভয়াবহ সত্যটা কি এতটাই... স্পষ্ট?” কক্ষে চুপচাপ নিস্তব্ধতা নেমে এলো, সবার হৃদয়ে এক অজানা আতঙ্কের ঢেউ দোল খেতে লাগল। কেউ কেউ চুপচাপ নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন, কেউ কেউ শুধু জানালা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভবিষ্যতের ভাবনায় মগ্ন। মুহূর্তটা যেন কালের স্রোত থামিয়ে দিয়েছে—একই সঙ্গে সেই নীরবতায় ভাসছিলো সকলের মনে প্রচণ্ড প্রশ্ন, “আমরা কি প্রস্তুত আছি? আসল যুদ্ধের জন্য নাকি বন্ধুত্বের জন্য? আমাদের সভ্যতার অস্তিত্ব কি ধুঁকছে?” হুকাস কিছু বলছে নাহ। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে।