Posts

সমালোচনা

রাজনীতির পরিণতির প্রতিচ্ছবি ও এক ‘স্লিপ অব টাং’কে ঘিরে বিকার

July 10, 2025

S. M. Shoaib Tasin

174
View
ছবি : সংগৃহীত 

রাজনীতির পরিণতির প্রতিচ্ছবি ও এক ‘স্লিপ অব টাং’কে ঘিরে বিকার

এস. এম. শুআইব ত্বাসীন 

জাতীয় নাগরিক পার্টির আয়োজনে চলমান জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির একাংশে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী সামান্তা শারমিন এক বক্তৃতায় বলেন, “জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীরা গত ১৫ বছর ধরে নির্যাতিত।” বক্তব্যটি প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গিয়েছে। অনেকেই এই মন্তব্যকে ভিত্তি করে এনসিপিকে আক্রমণ করার এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। তবে এই প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার, যুক্তি ও পরিপক্বতার পরিপন্থী, তা স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন। এই কথাটি নিঃসন্দেহে একটি “স্লিপ অব টাং” বা বাচনিক অসতর্কতা। কারণ সর্বজনবিদিত যে জাতীয় নাগরিক পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফলে ১৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথাটি বাস্তবতার নিরিখে নির্ভুল হবার উপায় নেই। বাংলাদেশে রাজনীতিতে বাচনিক ভ্রান্তি একটি পরিচিত বিষয়। অতীতে বহু রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা কিংবা টকশোতে অসংখ্যবার এমন ভুল উচ্চারণ করেছেন, যা নিছকই মুহূর্তের অসতর্কতা এবং পরে সংশোধনযোগ্য বলেই বিবেচিত হয়েছে। তবে বর্তমানে যে পদ্ধতিগতভাবে এই সামান্যতম ভুলকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দলীয় অ্যাক্টিভিস্টদের একাংশে যে বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনার স্রোত সৃষ্টি হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিশীলন প্রক্রিয়ার জন্য এক চরম হতাশাজনক দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রে যুক্তি, প্রেক্ষাপট ও কাঠামোগত অবস্থান বিশ্লেষণের যে অনিবার্যতা রয়েছে, তা বিসর্জন দিয়ে কোনো একটি কথার উপর ভর করে সমালোচনা চালানো কেবল আত্মতুষ্টির বৃত্তেই আবদ্ধ করে। কিন্তু কোনো বস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক পাঠ উপস্থাপন করে না। এ কথা অনস্বীকার্য যে এনসিপি-র রাজনৈতিক পথচলা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের ঐক্যশীল আবহের মাঝে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামক একটি তথাকথিত প্রেশার গ্রুপ গঠন করে বর্তমান এনসিপির নেতারা জাতীয় ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে স্পষ্টভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তৈরি হওয়া জাতীয় ঐক্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতার সাথে আলাপের সময় বলছিলেন জাতীয় নাগরিক  কমিটিই এনসিপি গঠনের প্রাক-পর্ব এবং এটি  সাংগঠন গোছানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে গঠন করা হয়েছিলো । অথচ ঐ মুহূর্তে রাষ্ট্র ও সমাজের অস্থির পরিস্থিতি ছিল সমগ্র জাতিকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়নের উপযুক্ত সময়। সেই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে তারা আদতে নিজেদের রাজনীতি গোছানোর জন্য কাজ করেছেন। তাদের রাজনীতি গোছানো নিয়ে আমার সমস্যা থাকার সুযোগ নেই, কিন্তু সমস্যা হলো এখানে তারা জুলাইকে ব্যাবহার করেছেন। নিঃসন্দেহে জুলাই ব্যাবসা করেছেন। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মুলা ঝুলিয়ে সমগ্র জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। এনসিপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদবির, চাঁদাবাজি ও টেন্ডার নির্ভর সুবিধাভোগের অভিযোগ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক মামলায় দলটির নেতাকর্মী কারাবরণ করছেন বলেও তথ্য রয়েছে।
সুতরাং এনসিপি-কে ঘিরে যে রাজনৈতিক প্রশ্ন ও সমালোচনার গ্রাউন্ড যথেষ্ট বিস্তৃত এবং বাস্তবসম্মত। সেই বিশ্লেষণের দরজা খোলা রেখে কাঠামোগত ও নীতিগত সমালোচনা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। কিন্তু একটি বক্তৃতার বাচনিক ভুলকে হাতিয়ার বানিয়ে অযাচিত বিদ্রুপ, মিথ্যা নিন্দা ও বক্রোক্তির মাধ্যমে রাজনীতির সমালোচনাকে যেভাবে অস্থিরতা ও তিক্ততায় পরিণত করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক শালীনতা ও রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিপন্থী। সমালোচনা যদি হয় সুশৃঙ্খল, যুক্তিনির্ভর ও কাঠামোগত তবেই তাতে রাষ্ট্র, সমাজ ও দলীয় রাজনীতির উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু যদি তা হয় কোনো বিক্ষিপ্ত বাক্যের উপর দাঁড়ানো আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া, তবে তা কেবল তুচ্ছতায় পরিণত হয়। রাজনীতি তখন আর নীতি কিংবা পথ নির্দেশ করে না, বরং হয়ে ওঠে তর্কের বিষাক্ত পাঁকে নিমজ্জিত। এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তখন বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, বিচারশক্তি এবং পরিণত রাজনৈতিক ভাষার অভ্যেস গড়ে তোলাই আমাদের একমাত্র পাথেয় হওয়া উচিত। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার লড়াই কোনো নির্দিষ্ট দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থানে নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে নীরব না থেকে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই হোক।

এস. এম. শুআইব ত্বাসীন 
৯ জুলাই ২০২৫
মহানগর প্রজেক্ট, হাতিরঝিল

Comments

    Please login to post comment. Login