পোস্টস

গল্প

বাংলা বল সাবান

২৬ মে ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

পরীক্ষার প্রিপারেশন আমার সবসময় খারাপ থাকে। ফলাফল কী হয় এরপর তা জানতে আইনস্টাইন হতে হয় না‌। তারপর আবার গোদের উপর বিষ ফোড়া‌ অবস্থা। ‌কৃতি ফ্যামিলির সন্তান হ‌ওয়ায় ফোড়াটা আকারে কোন পাহাড়ের চেয়ে ছোট নয়। আর ঐ পর্বতসমান ফোড়ার বিষাক্ত অবস্থা রেটল স্নেইকের বিষ‌কেও হার মানায়।
না। মেধার অভাব আমার নেই। প্রায় যেকোন বিষয় আমি দ্রুত আত্মস্থ করে নিতে পারি। কিন্তু কেন পড়াশুনায় মন নেই আমার? স্কুলে যে সিস্টেমে পাঠদান করা হয় তা আমার সহ্য হয় না। মনে হয় গর্দভদের জন্য‌ই যেন এ শিক্ষা-ব্যবস্থা একদম উপযুক্ত। অবশ্য এসব আমার স্টাডি না করার অজুহাত‌ও হতে পারে।
তো যা বলছিলাম। এক ধরণের ঘোরের মধ্যে দিয়ে আমি হেঁটে যেতে থাকি রোদ-বৃষ্টি-ঠান্ডার মাঝে। কত কিছু ভাবি এত কিছুর মাঝে।
রাস্তায় কটকটে রোদ আজ গায়ে জড়িয়ে আছে, অনেকটা অ্যানাকোন্ডার মতো। যেকোন সময় গিলে খেতে পারে অসচেতন পথচারিকে। আমি সচেতনতা-অসচেতনার উর্ধ্বে চলে গেছি মনে হয় মাঝে মাঝে। আমার রেজাল্ট নিয়ে বন্ধুদের (!) নিষ্ঠুর ঠাট্টা-মস্করা, বাসায় চিল্লাচিল্লি, শিক্ষকদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ চাহনি আজকাল সয়ে যাচ্ছে।
মহান কোন ব্রত নেই আমার। ধর্মতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করার দিকে মনোযোগ নেই এ মাথায়। ওসবের ভ্যালু দিনকে দিন যে কমছে তা আমি বুঝি। ইশকুল-কলেজের নীতিকথা শুধুমাত্র কথার কথা তা আমার জানা। কিন্তু জীবনে কিছু তো একটা করতে হবে।
এই কিছুটা কী তা নিয়ে একা একা হাঁটার সময় ভাবি। বয়সটা বরং উল্লেখ না করি এখানে। তবে আমি সেই বয়সে আছি যখন মনে হয় পৃথিবীকে নিজের পায়ের নিচে শাসন করার স্বপ্নটা এখনো সত্যি মনে হয়। নিজের সুতীব্র যাতনার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনো উড়িয়ে দেয়া থেকে আমি অনেক দূরে।
কঠিন রোদ গায়ে মেখে হেঁটে চলেছি। গা জ্বলা রৌদ্রজ্বল দিনে ওয়াক বিসাইড দ্য পার্ক খারাপ না।
ডিসি হিল পার্ক। এক‌ইসাথে পাহাড় এবং পার্ক। যেমন আমি এক‌ইসাথে বুদ্ধিমান ও গাধা।
ফুটপাতটা ছোট্ট। পাশেই অযত্নে থাকা সৌন্দর্য নিয়ে ডিসি হিল দাড়িয়ে আছে। নীরব স্বাক্ষী দিচ্ছে যেন কালের।
রিকশার টুংটাং, গাড়ীর হর্ণ, মানুষজনের বেসুরো কিচিরমিচির হিলের নীরবতাকে একটুও টলায় না যেন।
আমি কিন্তু সেই ক্যাওটিক ফুটপাতের অপর প্রান্তে। সেই আমাকেই ছুটে যেতে হলো নানা রঙের মানুষভর্তি ডিসি হিল সংলগ্ন ওয়াক‌ওয়ের দিকে।
ছোট্ট একটি মেয়ে, বয়স আনুমানিক ৭-৮ হবে। গরীব ঘরের সন্তান হ‌ওয়ায় নিজে নিজেই ব্যস্ত সড়ক পার হতে পারে। মহাজাগতিক সমস্যাটা বাঁধালো সে যখন তাঁর হাত থেকে সাবানটা রাস্তায় পড়ে গেলো।
বাংলা বল সাবান। ঐতিহ্যবাহী ব্যাপার-স্যাপার। সম্ভবত মেয়েটির মা ঠিক অর্ধেক করে কেটে দিয়েছেন বলটি। অর্ধবৃত্ত আকারের জিনিসটি গাড়ি-রিকশা-ভ্যানে আক্রান্ত রাস্তার মাঝামাঝি চলে গিয়েছে। এখন সক্রেটিসের ভাষায় টায়ার্ড হয়ে থেমে গেছে।
প্রচন্ড ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা কোন শিশুমুখে আগত হলে সেটা কী ভাষায় লিখা যায়। আমার লেখালেখির হাত এতোটা ভালো নয়। আপনারা ঠিকঠাক কোন শব্দ বলে দিন।
বল সাবানটি উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটা। ডানে-বামে থেকে যন্ত্রদানবের দুরন্ত গতির কারণে সাহসে কুলোচ্ছে না তাঁর, রাস্তার মাঝখানে যাওয়ার।
এর মধ্যে এক রিকশার সরু চাকা সাবানটির উপর দিয়ে চলে গেলো।
"আমার আব্বা আমারে মাইরা ফালাইবো।" অস্ফুট কান্নাভরা চিৎকারের পর মেয়েটা আমাকে তা-ই বললো। অর্ধবৃত্তাকার সাবানটি এখন কিছুটা বিকৃত আকৃতির। চলন্ত যানবাহনের সামনে লাফ দিয়ে আমি সেটি উদ্ধার করার আগেই কাম আংশিক তামাম হয়ে গেছে ঐ বল সাবানের অর্ধেকের।

বাচ্চা মেয়েটিকে রাস্তা পার করিয়ে দেয়ার পর একবার মাথায় আসছিলো এরকম একটি সাবান কিনে দেয়ার। তারপর মনে হলো, "আমার এত কী দায় পড়েছে? অনেক তো করলাম সাহায্য। ছড়ে যাওয়া হাত-পা ঠিক করতেও তো টাকা-পয়সা লাগবে।"
তাছাড়া পকেটে টাকাও তো থাকা দরকার। না। খালি পকেট ছিলাম না। হয়তো আমার লেখাপড়া না করার কারণের মতোই কোন অজুহাত এটি।
ডিসি হিলের ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় শেষবারের মতো একবার ফিরে তাকালাম। এক মূহুর্তের জন্য যেন মিরাকল হলো। নিজের ফিজিক্যাল পেইন কোথায় যেন চলে গেলো।
বিভিন্ন অদ্ভুত দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে ভাবতে লাগলাম,
"ছোট্ট মেয়েটি আজ বাসায় তাঁর আব্বার হাতে কী মাইরটাই না খাবে?"