পর্ব ১ – কালো ঘরের প্রথম সন্ধ্যা
আগমন
গরমের ছুটি।
ঢাকার কোলাহল থেকে দূরে, রায়হান আর রুদ্র তাদের মামার সঙ্গে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। ট্রেন থামে এক ছোট্ট স্টেশনে। চারপাশে বড় বড় গাছ, পাখির ডাক আর বাতাসে ধুলো। মামা হাত নাড়লেন, “এইদিকে! এইদিকেই আমাদের বাড়ি!”
রুদ্র বলল, “মামা, এখানে এত সুনসান কেন? কেউ দেখি না তো!”
মামা একটু গম্ভীর গলায় বললেন, “এই গ্রামে এখন কম মানুষ থাকে। সবাই তো শহরে চলে গেছে। আর যারা থাকে, তারা সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয় না।”
রায়হান হাসে, “আবার সেই ডাইনি গল্প?”
মামা তাকালেন না, শুধু বললেন, “সন্ধ্যার পর জানালা বন্ধ রাখো, বুঝলে?”
কালো ঘরের প্রথম অনুভব
বাড়িটা ছিল দোতলা, লাল ইটের তৈরি। নিচতলায় ছিল কাঠের দরজা, আর দালানে ছাউনি দেয়া। একপাশে জঙ্গলের সীমানা।
ঘরে ঢুকেই রুদ্র বলল, “ভাইয়া, এমন ঠান্ডা কেন? ফ্যান তো চলে না!”
রায়হানও খেয়াল করল—ঘরের বাতাস অস্বাভাবিক ঠান্ডা। দেওয়ালে ধুলার আস্তরণ, কিছু পুরনো ছবি। একটায় একটা বাচ্চা মেয়ে—কিন্তু তার চোখটা কেমন যেন আঁধারে ভরা।
রাত্রি নামে ধীরে ধীরে।
সেই কান্না
রায়হান ও রুদ্র রাতের খাবার খেয়ে যখন ঘুমাতে যাবে, হঠাৎ তারা শুনতে পায়...
একটি মেয়ে কাঁদছে।
শুরুতে মনে হয়েছিল বিড়াল।
কিন্তু না, কান্নার স্বরটা ছিল অতিপ্রাকৃত—তাকেই যেন কেউ চাপা দিয়ে রাখছে।
রুদ্র উঠে জানালার কাছে গেল।
মামা দ্রুত এসে বললেন, “না! জানালায় যেও না!”
রুদ্র পিছিয়ে এল, কিন্তু রায়হান কৌতূহলী।
সে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল…
একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মুখে। সাদা জামা, মাথা নিচু। কিন্তু বাতাস নেই, তবুও তার চুল বাতাসে ওড়ে।
রায়হান দেখতে চাইল তার মুখ…
ঠিক তখন সেই মেয়ে মাথা তোলে।
চোখ... লাল।
মুখ নেই, কেবল এক ফাঁকা গহ্বর।
রায়হান চিৎকার করে পেছনে হটে যায়। ঘরের বাতি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্ধকারে ছায়া
মামা তাদের তিনজনকে বসার ঘরে একসাথে থাকতে বলেন। তিনি দরজা, জানালা সব বন্ধ করে দেন।
— “তোমরা যদি জানত, এই বাড়িতে কে থাকত...”
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “কে থাকত?”
মামা উত্তর দেন না। তিনি একটা কাঠের বাক্স এনে আগুন ধরান।
বললেন, “আগুনের আলোতেই বাঁচা যায়...”
রাত গভীর হয়। ঘরের ভিতরে হঠাৎ করে টুপটাপ শব্দ।
রুদ্র ফিসফিস করে বলে, “কে হেঁটে বেড়াচ্ছে?”
পায়ের শব্দ, যেন কেউ দোতলা থেকে নামছে।
কিন্তু এই বাড়িতে তো আর কেউ নেই...
তারা দরজার নিচ দিয়ে ছায়া দেখতে পায়—লম্বা, টানটান চুল, খালি পা।
দরজা খুলে গেল...
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্ত তখন এলো, যখন হঠাৎ করে বন্ধ দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল…
কেউ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু তাকে দেখা যায় না। শুধু পায়ের কাছে জল পড়ছে টুপটাপ করে, আর এক নারীর ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে…
— “আমাকে দেখেছো…”
রায়হান, রুদ্র ও মামা ভয়ে চুপ করে থাকে। তখন সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ভিতরে আসে, আর আলো নিভে যায়।