অঙ্কের স্যার ক্লাসে তার চিরাচরিত লেকচার দিচ্ছিলেন। অঙ্কের পাশাপাশি তিনি সময় পেলেই নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা করতেন। কিন্তু আমার মন একদমই ক্লাসে ছিল না। এদিক-সেদিক চোখ ফেরাতেই হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে গেল।
কালো ড্রেস, মাথায় সাদা ওড়না পেঁচানো, কালো ডাগর চোখ – আমি কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না। অপরূপা সে! হঠাৎ ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল। এই প্রথমবার আমি ছুটির ঘণ্টার শব্দে বিরক্ত বোধ করলাম।
সবাই যখন বাড়ির দিকে রওনা দিল, মেয়েটিও ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, আর আমি চলতে লাগলাম তার পেছনে পেছনে। বাতাসের এক হালকা পরশ আমার শরীর ছুঁয়ে গেল, মনে হলো এক অদ্ভুত অনুভূতি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি, টেরই পাইনি।
বাড়িতে প্রবেশের আগে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। পিছনে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল – সেই হাসিতে মনে হলো তার মুখ থেকে যেন মুক্তো ঝরে পড়ছে। চোখ দুটো ঝলমল করছিল। কোনো কথা না বলেই সে ভেতরে চলে গেল।
রাত তখন প্রায় দুটো। বাইরে গভীর অন্ধকার, মনে হচ্ছে যেন কেউ পৃথিবীর ওপর একটি কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছি, কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ছে।
পরদিন সকালে তার বাড়ির সামনে চায়ের দোকানে বসে তাকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় আছি। চারপাশে কুয়াশায় ঢাকা। সে লাল ড্রেস পরে বের হলো। গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে, আর আমি তার পেছনে পেছনে। চারদিকে যত কোলাহলই থাকুক, কিছুই কানে যাচ্ছে না। যেন সময় থেমে গেছে।
সে প্রতিষ্ঠানে ঢুকে গেল। আমি আবারো এক দোকানে বসে রইলাম, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর তার কথা ভাবছি।
হঠাৎ চোখ আটকে গেল — কিছু দূরে একটা ছেলে একটি মেয়ের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে চেনা চেনা মনে হলো। কাছে যেতেই বুঝলাম, এ তো আমার বোন! এক ছেলে তার সামনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে তার বন্ধুরা।
আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো, দাঁত চেপে ধরলাম। মাথায় রক্ত উঠে গেল। পাশে থাকা একটি সিএনজি থেকে স্টিলের লাঠি তুলে নিয়ে ছেলেটিকে পেটাতে লাগলাম। তার কপাল ফেটে রক্ত বের হতে লাগল। তার বন্ধুরা ভয়ে পালিয়ে গেছে।
শেষে ছেলেটি ক্ষমা চাইল।
রাত তিনটা বাজে। আমি এখনো ঘুমাতে পারছি না। দিনের ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল — আমি একজন ভাই হয়ে যা করলাম, তা কি সঠিক ছিল? কিন্তু আমিও তো দুই দিন ধরে এক মেয়ের পেছনে পেছনে হাঁটছি। তারও তো ভাই বা বাবা থাকতে পারে! যদি তারা জানে, তবে আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবে?
এভাবে ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে রাত ৩:৩৬। ঘুম না আসায় মন ভালো করতে ফেসবুকে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ স্ক্রল করার পর একটি ভিডিওর হেডলাইনে চোখ আটকে গেল:
“কিভাবে আপনার বোনকে সমাজ থেকে রক্ষা করবেন এবং ইসলামে নারীর অধিকার”
ভিডিওতে এক ব্যক্তি বলতে লাগলেন—
> “নারী হচ্ছে মায়ের জাত। তারা কোমলতা পছন্দ করে। কিছু পুরুষরূপী শয়তান তাদের কোমল কথা দিয়ে পথভ্রষ্ট করে। পুরুষ মজলিসে হাঁটলে কেউ তাকায় না, অথচ একজন নারী হেঁটে গেলে সবাই তাকিয়ে থাকে — এখান থেকেই শুরু হয় শয়তানের ধোঁকা।”
তিনি বললেন, শয়তান সরাসরি বলবে না "জিনা কর", সে ধাপে ধাপে বলবে, “চা খাও”, “গল্প কর”, “হাত ধরো”… তারপর একদিন হয়তো বলবে, “জিনা তো করছো না, এ আর এমন কী!”
শেষে তিনি কুরআনের আয়াত পড়লেন:
> "মু’মিনদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত করে এবং তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন।" (সূরা নূর, আয়াত ৩০)
> "আর নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত করে এবং লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে..." (সূরা নূর, আয়াত ৩১)
লোকটি বললেন, একজন পুরুষ যদি বিবাহিত হয় এবং ধর্ষণ করে, তবে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে — (সূরা নূর, আয়াত ২)। যদি এই বিধান কার্যকর হতো, তবে আমাদের সমাজে ইভটিজিং, ধর্ষণের হার অনেক কমে যেত।
রাত তখন ৪:২০। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোটবেলার স্মৃতি— বাবার হাত ধরে মসজিদে যেতাম। একসময় সবার প্রিয় ছেলে ছিলাম। কিন্তু তারপর কী যে হলো, ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হলাম।
তখনই মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে এল। আজান, যা আগে বিরক্ত লাগত, আজ মনে হলো এক প্রশান্তির ছোঁয়া। আমি কল করে ওজু করলাম, গুটি গুটি পায়ে মসজিদের দিকে রওনা দিলাম।
মনে মনে উচ্চারণ করলাম—
> “হে আমার প্রভু! আমি গুনাহ করেছি। আমাকে সঠিক পথ দেখাও। আমাকে আবার অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়ো না।”