Posts

উপন্যাস

রুনা লায়লার সুর ও কিংবদন্তি অবলম্বনে গীতি-উপন্যাস "মায়ার সিংহাসন"- ৬

July 11, 2025

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

240
View
অলংকরণ: রাজীব দত্ত

পর্ব- ৬: ফুলো কি রানি 

বড় বোনের কণ্ঠসৌরভে আজকাল সকাল বিকাল দুইবেলা পুরো বাড়ি ভরে থাকে।  ভোরে না‌ পারলেও সন্ধ্যার আগে এক ঘণ্টা আমাদের সুরের রাজকন্যার কেটে যায় সেই সুরের দোলায়। সারা বাড়ি উজ্জ্বল করে পরের পুরো দিন তিনি বোনের কণ্ঠে শোনা কঠিন সুরগুলো গুন গুন করে গাইতে থাকেন। তার বছর চারেকের মন এখনও অস্থির চঞ্চল। এক গানের সুরের সাথে আরেক গান মিশে যায়। মাঝে মাঝে হয়তো অর্থ না জানা কথাগুলোও ভুলে যান, কিন্তু শক্ত সুরের সাধনা একদিনের জন্যেও থামে না। 

তাঁর এই সঙ্গীত সাধনা চলছিল আসলে সবার অজান্তে। নাচ আর গানকে তখনও আলাদা করতে শেখেন নাই তিনি। গানের সাথে অনায়াসে মিশিয়ে দিতে শুরু করলেন ঘুঙুরের ঘোর। দূর থেকে মা বাবা বোন তাই কেবল নাচটাই টের পেতো।   তাঁর কলাপাতা কণ্ঠ মূলত খুব সহজাত ঢঙে তখন  প্রস্তুত হচ্ছিলো, সকলের জানার আড়ালে।  বেশিদিন অগোচরে কাটলো না যদিও। বছর না ঘুরতেই  এক দক্ষ জহুরীর  কানে ধরা পড়ে গেলেন আমাদের সঙ্গীতের এই মহামূল্যবান রত্ন।

মাশাআল্লাহ, কেয়া আওয়াজ পায়ি হ্যায়!

মাগরিবের আজানের তখন বোধহয় মিনিট দশেক বাকি।  হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক দরাজ গলা স্নেহ মেশানো  ডাকে তাঁকে থামিয়ে দিল। মাথায় চলছে শেষ করতে না পারা সঞ্চারী  অন্তরা। পাঁচ বছর বয়সী সুরের রাজকন্যা ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন  তাঁর বোনের ওস্তাদ চোখভর্তি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

আওয়াজ তো লাজওয়াব হ্যায়!

পরের বিকেল থেকে তাঁকেও বোনের সাথে গলা মেলাতে বসতে হলো। না নেচে এই প্রথম গান গাওয়া। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলেন না। একবার গাওয়া শেষ হতেই ছুটে চলে গেলেন বারান্দায়। এবার দুই বোন দুই দিক থেকে গাইছেন। ওস্তাদ তানপুরায় হাত রেখে উপভোগ করতে লাগলেন এক জোড়া অপূর্ব আওয়াজের জৈবিক যোগাযোগ। গর্বে তিনি তৎক্ষণাৎ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, দুই বোন মন খুলে গাইছেন দেশের সবচেয়ে বড়ো অডিটোরিয়ামে। কানায় কানায় পূর্ণ ঘরে দর্শক পিনপতন নীরবতায় প্রাণ ডুবিয়ে শুনছে একটার পর একটা রাগ রাগিনী। শ্রোতাদের কান ভেসে যাচ্ছে অপার বিস্ময়ে। 

পরের বছর শীতকালে ওস্তাদের কল্পনার আংশিক সত্যি হলো। তবে মঞ্চে উঠলেন ছোট বোন একা। আয়োজকদের পরিকল্পনা, পোস্টার থেকে শুরু করে আমন্ত্রণ পত্র সবখানে আবার শিল্পী হিসেবে বড় বোনের উল্লেখ। গাওয়ার কথা ছিল তাঁরই। আগের সন্ধ্যায় হঠাৎ শুরু হলো সর্দি কাশি জ্বর। আয়োজকদের একটা দল উদ্বেগ নিয়ে ছুটে আসলো রাত আটটার পর। কী উপায় এখন! টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে প্রায় সবগুলো। সবাইকে টেলিফোনেও এই মুহূর্তে না করা সম্ভব না। টাকা ফেরত দিতে হলে, সেই প্রক্রিয়া আরো জটিল। কুলকিনারাহীন দুশ্চিন্তা বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুখ খুললেন মা।

আমাদের ছোট মেয়েকে দিয়ে নিশ্চিন্তে গাওয়াতে পারেন কিন্তু। আই ক্যান এনশিওর ও দর্শকদের কোনভাবেই হতাশ করবে না। 

সুর সম্রাজ্ঞীর মা নিজেও রেডিওর গায়িকা ছিলেন এক সময়। এখনও নিয়ম করে বিচিত্র রকমের গান শোনেন তিনি। কবিতার লেখার ঝোঁকও আছে সেই তরুণ বয়স থেকেই‌। আজকাল যদিও গাইবার, লিখবার সময় একদমই বের করতে পারেন না। বড় মেয়ের জন্মের পাঁচ বছর পর আরেকজনের জন্ম। মাঝখানে ভেবেছিলেন অনিয়মিত হলেও এখানকার রেডিওতে গাইবেন। কিন্ত এর মধ্যে স্বামীর চাকরি সূত্রে শহর বদলাতে হলো কয়েকবার। সব মিলিয়ে শেষমেশ পেরে উঠলেন না। এখন তিনি আশায় আছেন দুই মেয়েকে নিয়ে। খুব ইচ্ছা বড়োজনকে নামকরা গায়িকা আর ছোটজনকে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হিসেবে তৈরি করবেন। এই প্রত্যাশাগুলো পূরণের জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে  প্রস্তুত তিনি।

আয়োজকরা এই আত্মবিশ্বাসী মা ও আন্তরিক সঙ্গীত অনুরাগীর পরামর্শ অবশেষে ফেলতে পারলো না‌। পরের দিন সন্ধ্যায় মা কিছুটা কাঁপা মন নিয়েই বসলেন দর্শক সারিতে। তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়ে, অন্যদিকে, ভয়-ডর-সংকোচহীন পায়ে উঠে গিয়ে বসলো মঞ্চের ঠিক মধ্যখানে। তানপুরার আড়ালে ছোট্ট শরীরের প্রায় পুরোটা ঢেকে গেছে‌‌। আশেপাশের দর্শকেরা কেউ বিরক্তি, কেউ অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে। দুই একজন তো মিলনায়তন ছেড়ে চলেও গেল। মায়ের মনে তখন দুইটা বিপরীত অনুভূতির ঝড়। এতোটুকু মেয়ে এতো বড়ো চ্যালেঞ্জ পারবে তো উতরে যেতে? কাঁচা মন আবার গভীর কোনো কষ্ট পাবে না তো? মেয়েটা এমনিতেই তাঁর অবিশ্বাস্য রকম সংবেদনশীল।

কিন্তু মেয়ে রাগ-প্রধান খেয়াল গাওয়ার জন্যে গলা খোলার সাথে সাথে মায়ের মনে জমা সমস্ত ভয়ের বুদবুদ উড়ে চলে গেল। স্নেহ আর অহঙ্কার মিলিয়ে এক উজ্জ্বল আবেগে ভেসে তিনি উপভোগ করতে লাগলেন আত্মজার অমূল্য কণ্ঠস্বর। তাঁর নিজের শরীর ভেঙে সৃষ্টি হওয়া আরেক সত্ত্বা এতো অনবদ্য গাইছে যে একটু পর পর তিনি বাস্তব অবাস্তবের ভেদ ভুলে যাচ্ছেন।

এই অবাস্তব অনুভূতি আরও গাঢ় হলো, তাঁর দুই মেয়ে যেদিন একসাথে প্রথম সিনেমার গান গাইলো।  শুরু হয়েছিল ছোটজনকে দিয়েই। ওর বয়স তখন বারোও হয় নাই। একদিন তাদের বাবা অফিস থেকে ফিরেই জানালেন তাঁর কাছে আজ লাহোর থেকে একজন সুরকার এসেছিলেন অসম্ভব এক প্রস্তাব নিয়ে।

তোমার ছোট মেয়েকে দিয়ে উর্দু ছবিতে গান গাওয়াতে চায়। এমনিতে বাসায় শিখছে, ভালো কথা।  ঘরোয়া প্রোগ্রাম বা রেডিওতে গাইবে তাও ঠিক আছে, তাই বলে সিনেমায়!

কিন্তু উনারা ওর খোঁজ জানলো কোথায়? 

মা মনে মনে প্রচণ্ড খুশি হলেন কিন্তু খুব একটা প্রকাশ করলেন না। হয়তো আগে পুরো কাহিনী ভালোমতোন বুঝতে চাইছিলেন।

মেয়ের ইচ্ছা আছে কিনা জিজ্ঞেস করে দেখবো? আর সুরকার ভদ্রলোককে আসতে বলতে পারো কিন্তু। কথা বলে দেখি। একটা গান শখ করে না হয় গাইলোই সিনেমায়, ক্ষতি কী?

লাহোরের সেই সুরকার আসলে খুঁজছিলেন একজন ছেলে-কণ্ঠ। পর্দায় যাবেও একটা বারো বছর বয়সী ছেলের ঠোঁটে। কিন্তু পুরো লাহোর খুঁজে মনমতো কাউকে পান‌ নাই। শেষে আসতে হয়েছে রাজধানীতে। এসেই এখানকার নামকরা স্কুলগুলোতে খোঁজ শুরু করলেন। একদিন একই উদ্দেশ্যে গেলেন রেডিও স্টেশনে। মিউজিক ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের সাথে প্রথম বৈঠকেই, কপাল ভালো, সন্ধান মিলল এক অসাধারণ প্রতিভাবান বালিকার। বছর তিনেক আগে রেডিওর আন্তঃবিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলো, তখন আট নয় বছর বয়স।

পারফেক্ট!

শব্দটা বেশ জোরে উচ্চারণ করলেন ক্লান্ত সুরকার। হাতে পায়ে মনে হচ্ছে শক্তি ফিরে এসেছে। হাতের কাগজে মেয়েটার নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব টুকে নিলেন অতি দ্রুত। তারপর গুনগুন করে গাইতে শুরু করলেন লাহোর থেকে নিয়ে আসা অপ্রকাশিত সুরটা। দুর্বার এক ছন্দ তুলে ঝড়ের গতিতে নেমে গেলেন রাজধানীর রাজপথে।

মেয়েটার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলেই তিনি মুগ্ধ হলেন। কী জড়তাহীন উচ্চারণ। চোখে মুখেও দীপ্তি ঝরে। বাবা একটু অমত করছিলেন প্রথমে, কিন্তু কণ্যার বিস্ময়কর গুণ নিয়ে তাঁর মনে প্রচণ্ড গর্বও আছে বোঝা গেলো। মাকে মনে হলো সবচেয়ে আগ্রহী। যে একমাস মহড়া চলল, প্রতিদিন পুরোটা সময় সব কাজ ফেলে মেয়ের কাছে বসে থাকলেন। রেকর্ডিং এর দিন দেখা গেল নিজ হাতে চা বানিয়ে সবার আগে তিনিই প্রস্তুত। 

স্টুডিওর সামনে সেদিন বিকেল থেকেই প্রচণ্ড ভিড়। জটলাতে অবশ্য সাধারণ মানুষ হাতেগোনা কয়েকজন। বাকি সবাই রূপালী দুনিয়ার জনপ্রিয় সব তারকা। তাদের একত্রিত চোখ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বারো বছরেরও কম বয়সী বালিকাটির দিকে। আজকের মধ্যমণি। ঘাড় ছুঁই ছুঁই করা কালো চুলের বামদিকে সিঁথি করা, গায়ে ফুলেল প্রিন্টের ফ্রক। চোখেমুখে কৌতূহল। এতো ছোট মেয়ে আদৌ ঠিকঠাক গাইতে পারবে?  দর্শকের প্রায় সবাই এক ধরণের অবিশ্বাস নিয়ে বসে আছে জাদু অবলোকনের অপেক্ষায়।

গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি 

ফুলো কি রানি হ্যায় তু রাজদুলারি

সাড়ে এগারো বছর বয়সে ছবির জন্য প্রথম গাইতে দাঁড়িয়েই আমাদের সুর সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত শাসক প্রমাণ করে দিলেন তিনি কতখানি অনন্য। শব্দ বাক্য সব নতুন আবেশ নিয়ে ভেসে আসছে জীবনের গহবর থেকে। আনন্দে উদ্বেল হয়ে সুখের গান গাইছেন আর তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সামনে হাসছে প্রিয় বোনের মুখ। এক চরণ থেকে আরেক চরণে যাচ্ছেন আর বোনের চঞ্চল বাক্যগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। তাঁর কাছে তাই গান আর জীবনকে আজন্ম একাকার বলে মনে হলো, একে অন্যের থেকে আমরণ অবিচ্ছেদ্য। 


 

চলবে…
 

Comments

    Please login to post comment. Login