Posts

গল্প

বাবার শেষ চিঠি "

July 11, 2025

SAYED MOTIUR RAHMAN

104
View

 ছোট্ট এক বাড়িতে থাকত এক মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা মজিবর রহমান, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মা হাসিনা খাতুন, ঘর সামলানোই যার একমাত্র কাজ। আর তাদের একমাত্র ছেলে—রাহুল। রাহুল ছিলো বাবার চোখের মণি। সন্তানকে মানুষ করাই ছিল মজিবরের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।

স্কুল থেকে ফিরে বাবার কোলেই বসে থাকত রাহুল। সে জানত, তার বাবা বড় কিছু করতে পারবে না, কিন্তু বাবা যেন তার জন্য পাহাড়। কখনো মাথা নিচু করেনি, কখনো মিথ্যা বলেনি, কোনোদিন অন্যায় মেনে নেয়নি। মজিবরের আয় কম ছিল, কিন্তু সম্মান ছিল অনেক। নিজের ভাঙা জুতাটাও নতুন করে সেলাই করিয়ে পরতেন, যেন টাকার অভাবে শিক্ষার্থী বা সন্তান কষ্ট না পায়।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে রাহুল বাবাকে জিজ্ঞেস করল,  
“বাবা, আমি কি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব?”

বাবা চোখে জল নিয়ে হেসে বললেন,  
“হবে রে বাপ। শুধু চেষ্টা করে যাস। বাকি দায়িত্ব আমার।”

কিন্তু সেখান থেকেই গল্পের যাত্রা শুরু—জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তখনো রাহুল জানত না।

সময় বয়ে গেল। এসএসসি, এইচএসসি পাস করে রাহুল ভালো রেজাল্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। গর্বে বুক ফুলে উঠল মজিবরের। কিন্তু ঢাকা শহরের ব্যয়বহুল জীবন তাকে ধীরে ধীরে গলাটিপে ধরল। রাহুল হোস্টেলে থাকত, পড়াশোনা আর টিউশনির মাঝেই জীবন চলছিল।

হঠাৎ একদিন রাহুল ফোনে জানালো, তার ল্যাপটপ দরকার। ক্লাসের প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। মজিবর কিছুদিন সময় চাইল। পরের সপ্তাহে বাড়ি থেকে একটি পুরনো ব্যাগে করে একটি নতুন ল্যাপটপ পাঠানো হলো। সাথে একটি চিঠি।

রাহুল তখন ব্যস্ত, ব্যাগ খুলে ল্যাপটপটা বের করলো, কিন্তু চিঠিটা পড়লো না। ওর হয়তো সময় ছিল না, হয়তো দরকার মনে হয়নি।

দিন যায়, মাস যায়। বাবার ফোন কল আসলেও সে অনেক সময় ধরত না। ব্যস্ততা, ক্লাস, বন্ধুবান্ধব, আর নতুন জীবনের অভ্যস্ততা। বাবার মুখটা যেন কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। মা বলতেন,  
“বাবারে, তোর বাবা সারাদিন তোকে নিয়ে কথা বলে, তোকে দেখলে কতটা খুশি হয় ভাবতেও পারবি না।”

রাহুল বলতো,  
“আচ্ছা মা, পরে কথা বলি, একটু ব্যস্ত আছি।”

তখন মা কেঁপে কেঁপে বলতেন,  
“আমাদের কথা তো এখন আর দরকার নাই বাবারে, তুই ভালো থাকলেই হলো।”

একদিন হঠাৎ ফোন এল।  
“তুই দ্রুত বাড়ি আয় রাহুল। তোর বাবার অবস্থা ভালো না।”

রাহুল ছুটে এলো। বাড়িতে এসে দেখে, বাবা আর কথা বলছে না। শুয়ে আছে নিঃসাড় হয়ে। চোখ বন্ধ। মুখে অদ্ভুত এক শান্তি।

চিৎকার করে উঠলো রাহুল,  
“বাবা… আমি এসেছি… দেখো বাবা, তোমার ছেলে এসেছে…”

কিন্তু বাবার চোখ আর খোলেনি।

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে রাহুল প্রথমবার কাঁদল। এতদিনের আবেগ, অবহেলা, সবকিছু যেন পাহাড় হয়ে বুকের মধ্যে জমে ছিল।

মা বললেন,  
“তোর জন্যই তো এভাবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করলো রে। তিনমাস আগে ওর হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তার অপারেশন বলেছিল। কিন্তু তোর পড়ার জন্য কিছু বলেনি। ওর চিকিৎসার টাকা দিয়ে তোর ল্যাপটপ কিনেছিল…”

রাহুল স্তব্ধ। মনে পড়লো ব্যাগের সেই চিঠির কথা। যেটা সে কখনো পড়েনি।

ব্যাগের তলানিতে তখনো চিঠিটা ছিল। ধুলো জমে গেছে।

চিঠি খুললো সে—বাবার হাতের লেখা।

---

**“আমার প্রিয় রাহুল,**

**তুই যখন এই চিঠিটা পড়বি, তখন হয়তো আমি তোর পাশে থাকব না, কিংবা থাকলেও হয়তো আর কিছু বলার মতো শক্তি থাকবে না।**

**এই ল্যাপটপটা তোর দরকার ছিল, আমি জানি। আমি একটুও কষ্ট পাইনি এটা কিনতে গিয়ে, কারণ আমি জানি, আমার সন্তানের ভবিষ্যত এই ল্যাপটপের সঙ্গে জড়িয়ে। আমি হয়তো একজীবনে কিছু করতে পারিনি, কিন্তু তোর চোখে আমি আমার স্বপ্ন দেখি।**

**তোকে একটাই কথা বলি—জীবনে কখনো সময়ের জন্য অপেক্ষা করিস না। যারা সময়কে হার মানায়, তারাই ইতিহাস গড়ে। আমি তোকে ইতিহাস হতে দেখি।**

**আরেকটা কথা, মা’কে কখনো একা ভাবিস না। ওর জন্য তুই আমার পরে একমাত্র ছায়া। ও তোকে অনেক ভালোবাসে, তুই জানিস না। আমি যেদিন থাকব না, সেদিন তোর কাছে ওর খবর নেব।**

**ভালো থাকিস রে।  
তোর গর্বিত বাবা,  
মজিবর রহমান।**”

---

চিঠিটা পড়ে রাহুল ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সময় তাকে মানুষ করেছে, কিন্তু বাবার অভাব তাকে ভেঙে দিয়েছে।

এরপর রাহুল আর কখনো সময় নষ্ট করেনি। সে দিনরাত পরিশ্রম করে ইঞ্জিনিয়ার হলো। মায়ের খেয়াল রাখত, প্রতিবছর বাবার কবর জিয়ারত করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে “মজিবর মেমোরিয়াল স্কলারশিপ” নামে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের জন্য একটা ফান্ড গঠন করেছিল।

একদিন তার একটা বক্তৃতায় বলেছিল—

“আমার বাবা একজীবনে যা পারেননি, তার চেয়েও বড় কিছু আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত দরিদ্র, কিন্তু অন্তরে ছিলেন একজন রাজা। আজ আমি যেখানেই থাকি, আমার মাথার ওপর তার দোয়ার ছায়া অনুভব করি।”

---

**শিক্ষা:**  
সময় আমাদের হাতে থাকে না, কিন্তু ভালোবাসা, দায়িত্ব আর কৃতজ্ঞতা আমাদের হাতে থাকে। বাবা-মা কখনো বেশি কিছু চায় না, শুধু চায় তাদের সন্তান মানুষ হোক, ভালো হোক। জীবনের পথে ব্যস্ততায় আমরা সেই মানুষদের ভুলে যাই, যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য উৎসর্গ করে দেন। সময় থাকতে তাঁদের ভালোবাসুন, কারণ একদিন সেই সময় হয়তো আর আসবে না।

**শেষ কথা:**  
চিঠিটা পড়ে যদি চোখে জল আসে, তাহলে আজই বাবা-মাকে ফোন করে বলুন—“ভালোবাসি।” কারণ, তাঁরা অপেক্ষা করছেন।

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Tazim Parvez 4 months ago

    অনেক সুন্দর হয়েছে লেখাটা

  • Md.Shohag Hossain 4 months ago

    Interestedtjlugm dson cdjonxsjjhk