প্রথম অধ্যায়: **অভাগিনী জন্ম**
তিতিরের জন্ম হয়েছিল এক জ্যোৎস্না ভরা রাতে। অথচ সেই বাড়িতে আলো ছিল না, ছিল না কারো মুখে হাসি। গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া মানেই যেন অভিশাপ নিয়ে আসা। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলত,
"আবার মেয়ে হইছে? এইবার তো ছেলে হইবে আশা করছিল!"
তিতিরের মা জাহানারা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতেন, আর তার বাবা তো সেই জন্মের দিনই বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরেনি।
তিতির বড় হতে লাগল মায়ের কাঁধে ভর করে। গ্রামের স্কুলে হেঁটে যেত, পুরোনো বই, ছেঁড়া জামা, ছিদ্রযুক্ত ছাতা—এই ছিল তার সঙ্গী। কিন্তু মেয়েটার চোখে ছিল স্বপ্ন, আর বুকের মধ্যে ছিল এক আগুন।
দ্বিতীয় অধ্যায়: **আলোর খোঁজে**
তিতির ক্লাসে প্রথম হতো। সবাই বলত,
"এই মেয়েটার চোখে কিছু একটা আছে।"
তিতির চুপ থাকত, শুধু ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করত। মা বলত,
"তুই একদিন অনেক বড় হবি রে মা। আমি আর তোর মতো জীবন চাই না তোদের ভবিষ্যতের জন্য।"
এসএসসি পাস করে তিতির কলেজে ভর্তি হলো, শহরে গিয়ে। মা তখন গৃহকর্মীর কাজ করে মেয়েকে পড়াচ্ছেন। নিজের খাবার কম খেয়ে মেয়ের টিউশন ফি জমিয়ে রাখেন।
তৃতীয় অধ্যায়: **ভাঙাগড়ার দিন**
কলেজে এসে তিতির বুঝল শহর মানে কেবল আলো না, এখানে অন্ধকারও গভীর। সহপাঠীরা যখন দামি ফোন নিয়ে সেলফি তোলে, তখন তিতির লুকিয়ে কাঁদে। ওর কোনো ফোন নেই। যখন এক বন্ধুর জন্মদিনে কেউ তিতিরকে ডাকল না, তখন সে বুঝল—গরিবদের একাকিত্বও একধরনের শাস্তি।
তবু তিতির হার মানল না। টিউশন পড়াতে লাগল, বই পড়ল, রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিল। তার একটাই স্বপ্ন—একদিন সে ডাক্তার হবে।
চতুর্থ অধ্যায়: **ভালোবাসা ও বেদনা**
এই সময়েই তিতিরের জীবনে আসে আরেফিন। শহরের এক নামী পরিবারের ছেলে, মেডিকেল কোচিংয়ে তিতিরের সহপাঠী। আরেফিন প্রথম দিনেই তিতিরের দৃষ্টি ও মেধায় মুগ্ধ হয়। ধীরে ধীরে তারা কাছাকাছি আসে।
তিতির প্রথমবার ভালোবাসা কী তা অনুভব করে। তারা একসঙ্গে স্বপ্ন দেখে, মেডিকেল কলেজে পড়ার, সমাজ বদলানোর। কিন্তু সমাজ কি তাদের এই সম্পর্ক সহজে মেনে নেয়?
না।
আরেফিনের পরিবার জানার পরেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করে। ওরা বলে,
"এক গরিব মেয়ের সাথে আমাদের ছেলের সম্পর্ক? অসম্ভব!"
তিতির আর কথা বলেনি। শুধু চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বলেছিল,
"তুমি যাও। আমি হারি নাই।"
পঞ্চম অধ্যায়: **মায়ের মৃত্যু ও বিসর্জন**
হঠাৎ একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মা বলে,
"তুই ভালো থাকিস মা। আমার জীবনের চাওয়া তুই পূরণ করিস।"
তিতির কাঁদে, হাত ধরে রাখে। কিন্তু জীবন আবারো তাকে কাঁদিয়ে দেয়। মা চলে যায়। চিরতরে।
মা’কে কবর দিয়ে এসে তিতির জানে, এখন তার আর কিছু হারানোর নেই। কিন্তু অনেক কিছু জেতার আছে। সেই আগুনই তাকে নতুন করে জ্বালায়।
শেষ অধ্যায়: **পুনর্জন্ম**
তিতির মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। প্রথম শ্রেণীতেই সেরা হয়ে ওঠে। একদিন গ্রামে ফিরল, সেই পুরোনো স্কুলে।
মেয়েরা দৌড়ে এসে বলল,
"আপা, আপনি আমাদের আইডল।"
তিতির হেসে বলল,
"আমি তো তোমাদেরই মতো মেয়ে। শুধু হাল ছাড়িনি।"
আজ তিতির নিজেই একজন ডাক্তার, মা-বাবাহীন মেয়েদের জন্য একটা হোস্টেল চালায়। তার নাম দিয়েছে—“জাহানারা নীড়”।
আর লেখে একটা ডায়েরি। যার নাম—**"তিতিরের দিনলিপি"**। প্রতিটি পাতায় লেখা থাকে তার চোখের জলের গল্প, লড়াইয়ের ইতিহাস, আর এক অনন্ত বার্তা—
“হাল ছাড়লে হার, লড়লে বিজয়।”
---
**উপন্যাসের বার্তা:**
এই উপন্যাস কেবল তিতিরের না—এটা প্রতিটি মেয়ের যাত্রা, প্রতিটি সংগ্রামী মায়ের স্বপ্ন, আর সমাজের চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
**শেষ কথা:**
যদি তিতিরের গল্প আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তাহলে আজ থেকেই স্বপ্ন দেখুন, লড়াই করুন, আর একটাও ‘তিতির’কে সাহস দিন।