মিস্টার, এই প্রস্তর যুগের নির্মাতা তো আপনারাই। তাড়া খাওয়া আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা ছিল আপনাদের। কী শিক্ষাটা নিলেন আপনারা? কী নির্বিকারভাবে আপনাদের কেবিনেট মেম্বার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলে দিলেন, সরকার বারবার তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সেটি হচ্ছে, মব জাস্টিস সরকার কোনভাবেই বরদাশত করে না। এখন যেই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে কোনো সরকার বা সরকারি দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যখনই মব জাস্টিস ঘটছে, অন্তত গত ৩-৪ মাসে আপনারা দেখেছেন, যেখানেই খবর পাচ্ছি সেখানেই আমরা আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি এবং কোনো আসামি আর বের হতে পারছে না।'
এখন সরকারি দল আসলে কোনটা? এর ক্লারিফিকেশন জরুরি। জানতে পারলে আমরাও সরকারি দলকে সমঝে চলব। আর আসামিদের ছাড়া হচ্ছে না বলছেন? হাউ রিডিকুলাস! সকল শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ধর্মীয় এক্সট্রিমিস্টকে জেল থেকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে মুক্তির পর আসামি ছাড়া না ছাড়ার কথা খুবই বেমানান।
বিএনপি তো গত দেড়যুগ হলো ক্যানভাসের বাইরে, তাদের শেখা না শেখায় জনগণের দিনরাত বদলায় না। কিন্তু আপনারা তো ক্ষমতার স্টিয়ারিং হাতে রেখে হর্ন বাজিয়ে চলছেন, ‘আমরাই উন্নয়ন, আমরাই সুশাসন! উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!’
কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জলকে দিনে দুপুরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো—তার বিচার তো দূরের কথা, সরকারের তরফ থেকে একটা আইনি বিবৃতিও আসল না। গেল ১১ মাসে দেশে খুন হয়েছে কয়েক শ’ মানুষ, ধর্ষিত হয়েছে অগণন নারী ও শিশু। আপনারা কয়টার বিচার করেছেন? বিচার না হোক, অন্তত লজ্জাবোধটুকু কোথায়?
গত ১০ মাসে দেশের আট বিভাগে ১৭২ জনকে এভাবে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির তথ্য বলছে, কোথাও চোর-ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ও দোসর অপবাদ দিয়ে মব সৃষ্টি করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও ছিল না।
চাঁদপুরের মসজিদে ইসলামিক স্কলার নুরুল আমিন মাদানী তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও হারালেন। পাশের অশিক্ষিত সবজিওয়ালা বিল্লাহ হোসেন ইমামের বয়ানে ক্ষুব্ধ হয়ে খুন করতে চাইলেন। সভ্য দেশে এমন বর্বরতা ঘটলে সরকার কেঁপে উঠত। আর এখানে? ‘দোষ করেছে তো মরেছে’, এই কি আপনাদের নির্বিকার নৈতিকতা?
মিটফোর্ডে, রাজধানীর ব্যস্ততম জনপদে, লাল চাঁদ নামের একজন ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো, অথচ মিডিয়া নামের পোষ্য বরাহগুলোর গন্ধ পেতে দু’দিন লাগল। তাও আবার ফেসবুকের কল্যাণে! এই রকম নির্বোধ, নির্বিকার, নির্বাক মিডিয়ার জাত কেউ আগে দেখেছে? আপনারাই দেখালেন মিস্টার আসিফ!
একের পর এক লিঞ্চিং, মব আয়োজনে পিটিয়ে হত্যা, পথচারীদের নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা—এই ভয়াবহ সামাজিক মনোবৃত্তির কারখানা তো আপনারাই! শাসনের নামে শাসাচ্ছেন, সংস্কারের নামে কুসংস্কার ছড়াচ্ছেন।
মিস্টার আসিফ, মানুষ আপনাদের হাতে ক্ষমতার চাবি তুলে দিয়েছিল এই আশায় যে, পচন থামবে। আপনারা এসেই লাস্ট রেজিমের নোংরা ম্যানুয়ালগুলো হুবহু তুলে নিলেন—তাতে একটু ফ্লেভার মিশিয়ে দিলেন, ব্যাস! সংস্কারের নামে ‘কুসংস্কারের’ বর্বরতা উপহার দিলেন জাতিকে।
বিএনপির হাতে বিএনপিপন্থী লোক নিহত হয়েছে—বর্বরোচিতভাবে। তারেক রহমানের পক্ষ থেকে অনুশোচনামূলক বিবৃতি পাওয়া গেল না। আমরা বিএনপির এমন জনবিচ্ছিন্ন নৈতিক দেউলিয়াপনার নিন্দা করি।
কিন্তু তবু মনে রাখবেন জনাব আসিফ, দেশটা এখন আপনারাই চালাচ্ছেন। খুলনায় বিএনপির সাবেক নেতার রগ কেটে হত্যার ঘটনা কি আবার সেই পুরনো রক্তাক্ত ট্র্যাডিশনের প্রত্যাবর্তন? এই দেশে রগ কাটাই কি এখনকার রাজনীতি?
চতুর্দিকে অনাচার, অত্যাচার, নিপীড়ন, গণপিটুনি, সামাজিক নিষ্ঠুরতার জোয়ার—আপনারা কী করছেন? কী অর্জন আপনাদের সাদাসিধে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর? ক্ষমতা ছাড়ার পরে কী মুখ নিয়ে জনগণের সামনে যাবেন? তোফাজ্জল, লাল চাঁদ আর অগণন নির্যাতিত আত্মার বিষাদসঙ্গীত যখন আপনাদের ঘুমচোখে হঠাৎ বাজবে, তখন বুঝবেন—ক্ষমতা গেলেও অভিশাপ থেকে তো কারোরই রেহাই মেলে না!
লেখক: সাংবাদিক
১২ জুলাই ২০২৫