তৃষার চোখে তখন ছিল একরাশ শান্ত বিষণ্ণতা। সে ধীরে বলে উঠলো—
"ধন্যবাদ দেয়ার কথা যদি হয়, তাহলে সেটা তো আমার বলা উচিত, মিস্টার আমান।"
মিস্টার আমান একটু চমকে তাকালেন তার দিকে।
"এই পরিস্থিতিতে... দাদীর কথা ভেবে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন, আমাকে সম্মান দিয়েছেন। একটা ছায়াহীন মুহূর্তে আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সত্যি বলছি, আমি জানি না কতটা আপনাকে বোঝাতে পারছি... কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ।"
তার কণ্ঠে ছিল বিনয় আর অদ্ভুত এক মাধুর্য। মিস্টার আমান কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন।
ওই দিকে আরিয়ান বারবার চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু যতবার চোখ বন্ধ করছিলো, ততবারই হেনার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো ভেতরের পর্দায়। হেনার কাঁপা গলায় বলা “সাহেব…” শব্দটা যেন গিয়ে বসছিলো তার বুকের গভীরে।
ঘুম আসছিল না। চোখ মেললেই জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল, কিন্তু মনের জানালায় শুধুই হেনা।
নিজের কপালটা ছুঁয়ে দেখলো—ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেছে।
"ও ঠিক আছে তো? ওখানে আবার কেউ গিয়ে কিছু করলো না তো? না জানি কত বিপদে আছে... আমি যদি না যেতাম... কিন্তু আমি তো কিছুই করতে পারছিলাম না..."
আরিয়ান উঠে বসে পড়লো বিছানায়। হাতে তখনো সেই কাগজের কার্ড—যেটা হেনার হাতে দিয়ে এসেছিলো।
"একবার হলেও দেখা উচিত... শুধু দেখে আসি, ঠিক আছে কিনা। তারপর ফিরে আসবো... আর কিছু না..."
তার ভিতরের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছিল। হেনার চোখের জল, তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্ট, সব মিলিয়ে একটা ভারী অনুভূতির পাহাড় জমে উঠছিল আরিয়ানের বুকের ভেতর।
এরপর পানি নিতে রুমের বাইরে আসলো। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে, যখন বাবা মার রুমটা ক্রস করছিল।
হঠাৎ থেমে গেলো......
আরিয়ান এক হাতে জগটা ধরে ছিল, অন্য হাতে পানির গ্লাস। কিন্তু কানটা যেন জমে গেলো ঠায় দাঁড়িয়ে।
তৃষার রিসেপশন… আমান সাহেবের দাদির পাঠানো কার্ড… চালের ড্রামের ভিতর লুকিয়ে রাখা…
সব শব্দ যেনো এক একটা ছুরি হয়ে এসে বিঁধে গেলো তার মনে।
"তৃষা…"
নামটা ঠোঁটের কোণে এসে আটকে গেলো।
পায়ের শব্দ না করেই ধীরে ধীরে আবার ফিরে গেলো নিজের ঘরে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে দরজাটা বন্ধ করলো।
পিছনে হেলান দিয়ে একটু ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লো। মাথাটা ঠেকিয়ে রাখলো দরজায়।
চোখ দুটো জ্বলছিল, কিন্তু কান্না আসছিল না।
তৃষা, যাকে এক সময় ভালোবেসেছিল, যে কি না তার কাছে শত বাধার পরেও বিশেষ ছিল… আজ তার রিসিপশন।
"এত তাড়াতাড়ি?"
মনে পড়ে গেলো—তৃষার চোখে জল, বিয়ের আগের মুহূর্তে তার অনিচ্ছা, আর সেই রাতে হেনার মুখ।
সব মিলিয়ে আরিয়ানের চারপাশ ঘোলাটে হয়ে উঠলো।
নিজের হাত দুটো দেখছিল—যে হাত এক রাতে দুই নারীর জীবনকে ছুঁয়ে ফেলেছে, একটাকে হারিয়েছে, আরেকটাকে ভেঙে দিয়েছে।
রুমের ভেতর নিস্তব্ধতা, শুধু টেবিলের ওপর রাখা হলুদাভ কার্ডটা ঘরে অনাহূত এক উপস্থিতির মতো জ্বলজ্বল করছে।
আরিয়ান কার্ডটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে, চোখের কোনা ভিজে গেছে।
হাতটা ধীরে ধীরে কাঁপছিল… রাগে, অভিমানে, বিষাদে।
“তৃষা… কিভাবে পারলে?”
চোখ বুজলেই মনে হচ্ছিল—তৃষা এখন অন্য কারো হয়ে গেছে।
কেউ একজন হয়তো তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেউ হয়তো তার গায়ে হাত রাখছে—
এই চিন্তাগুলো যেন বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছিলো বুকের ভেতর।
তার বুকের ওপর ছিল যে…
তৃষা কি কিছুই অনুভব করেনি?
নাকি সেও তাকে ভুলে গেছে এত তাড়াতাড়ি?
আরিয়ান দাঁত চেপে বসে পড়লো বিছানার পাশে, মাথাটা নিচু, ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
“তুই পারবি না আমাকে মুছে ফেলতে তৃষা… পারবি না…!”
কার্ডটা আচমকা ছিঁড়ে ফেলতে গেলো আরিয়ান।
না, সে ছিঁড়বে না।
সে ওখানে যাবে। সে দেখবে তৃষাকে। আর দেখে এসে হয়তো চিরকালের জন্য বদলে যাবে।
চলবে......