তৃষার বাসা থেকে আসা মহিলা গুলো এবার পাশের বাসা—অর্থাৎ আরিয়ানদের বাসায় গেল। দরজায় কড়া নাড়তেই আরিয়ানের মা একটু থমকে গিয়ে দরজা খুললেন।
মহিলা ঢুকেই শুরু করলেন,
"এই শুনেছো? তৃষার তো ভাগ্য খুলে গেল একেবারে! আমরা তো ভাবতেও পারিনি এমন একটা বিয়ে হবে ওর। কাল রাতেই তো কেমন কেমন কথা উঠছিল... তাও দেখো, কী চমৎকার রিসিপশন হচ্ছে আজ! জামাই তো একেবারে ১০০-তে ১০০!"
আরিয়ানের মা কিছু বলার আগেই তিনি আবার শুরু করলেন—
"তবে মেয়েটার চালচলন একটু শান্ত টাইপের... মাঝে মাঝে ভাবি এত চুপচাপ মেয়ে এত বড় ঘরে মানাবে তো? তবুও ভাগ্য ভালো, তাই এমন বর পেয়েছে।"
কথাগুলো বলতে বলতে তিনি আরিয়ানের রুমের পাশেই সোফায় বসে পড়লেন। তবে তার গলা এতই চড়া ছিল যে পাশের রুমে আরিয়ান সব শুনে ফেললো।
সে তখন অন্ধকার ঘরের এক কোণে বসে ছিল, চোখে ক্লান্তি আর না বলা ক্ষোভ। মহিলা যখন বলল "জামাই পেয়েছে ১০০-তে ১০০," তখন তার মুখটা হঠাৎ এক অদ্ভুত রাগে শক্ত হয়ে গেল।
তার মুঠো অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠলো।
“তৃষা... তুমি পারলে? তুমি কি সত্যিই... কাউকে নিজের করে নিলে?”
তার চোখে পানি, কিন্তু এবার সেই পানির সাথে অজানা এক আগুনও ছিল।
ভেতরে ভেতরে যেন সব কিছু একসাথে পুড়তে শুরু করলো।
আরিয়ান বুঝে গেল, সে তৃষাকে ভোলেনি, বরং আরও গভীরভাবে তৃষার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
মহিলা গুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলতে লাগলো—
"হ্যাঁ রে, আরিয়ান না কি তৃষার জামাই ওই আমান সাহেবের অফিসে কাজ করে, তাই না?"
পাশ থেকে আরেকজন তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
"আরেহ্ চুপ করো! মনে নেই বুঝি? তৃষার তো আরিয়ানের সাথেই বিয়ে হতে যাচ্ছিল, কত কী গল্প উঠেছিল তখন! ভুলে গেছো নাকি সব?"
এই কথা শুনে হঠাৎ চারপাশে একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
আরিয়ানের মা সেই মুহূর্তে চুপ করে গেলেন।
চোখ-মুখ একেবারে মলিন, বিব্রত। মুখে কিছু বলার মতো ভাষা নেই যেন।
একদিকে ছেলে, একদিকে সমাজ—আর তার মাঝখানে নিজেকে অসম্ভব ছোট মনে হচ্ছিল তার।
মহিলা গুলো নিজেদের কল্পনা আর মন্তব্যে ব্যস্ত, কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে পড়ে চলে গেলো।
তারা চলে যাওয়ার পর আরিয়ানের মা দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ করলেন।
হাতটা দরজার হাতলে রেখে চোখ বন্ধ করলেন।
তার বুকের ভেতর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস জমে উঠলো—
"হায় আল্লাহ, এই ছেলেটা যেন কোনো ভুল কিছু না করে বসে... তার মনটা আমি বুঝি না আজকাল..."
আর ভিতরে, আরিয়ান তখনো বসে।
সবকিছু শুনেছে।
সবকিছু… মনে গেঁথে নিচ্ছে একে একে।
আরিয়ান ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে এলো। চোখে অদ্ভুত এক স্থিরতা। মুখে কোনো ভঙ্গি নেই, তবু চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল যেন।
সে সরাসরি ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো:
"আমি যাচ্ছি। তৃষার রিসিপশনের দাওয়াতে আমি যাবো।"
শব্দগুলো শোনার সাথে সাথেই তার মা যেন আঁতকে উঠলেন।
"কি বলছো, আরিয়ান! তুমি ওখানে যাবে মানে? ওরা কি ভাববে, লোকে কি বলবে?"
আরিয়ান শান্ত গলায়, কিন্তু চূড়ান্ত দৃঢ়তায় বললো—
"এই নিয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। যা বলেছি, বলেছি। আমি যাচ্ছি।"
তার মা কিছু বলতে যাবেন এমন সময় তার বাবা ধীরে কিন্তু শক্ত কণ্ঠে বললেন—
"ওকে কিছু বলো না। ছেলেটা যা করতে চায় করতে দাও। অনেক কিছু সহ্য করছে ও... আজ ওর সিদ্ধান্তে বাধা দিও না।"
আরিয়ান তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সামনের দেয়ালের দিকে।
তার চোখে আগুন।
মন জ্বলছে।
আরিয়ান ধীরে ধীরে নিজের রুমে চলে গেলো।
দরজাটা বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে দিলো দেওয়ালের সাথে।
এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারছে না।
চোখের পাতার নিচে বারবার ভেসে উঠছে তৃষার মুখ—
তৃষার সুন্দর মুখ খানা, গলায় দামী ডায়মন্ড সেট, গায়ে রাজকীয় শাড়ি…
আর তার পাশে মিস্টার আমান… মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
আরিয়ান যেন দম নিতে পারছে না।
চোখে জমে উঠেছে পানি, কিন্তু সে সেটা মুছে ফেললো না।
"সব শেষ... সব চুরমার হয়ে গেলো... আমি কিছুই করতে পারলাম না…"
—আরিয়ান নিজের মনেই ফিসফিস করে বললো।
তার বুকের ভেতর এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, কিন্তু শুনবার কেউ নেই।
কেউ নেই বুঝবার মতো, জানবার মতো, কিংবা বলার মতো—
সে কাকে হারিয়েছে, কতটা হারিয়েছে।
সামনের আয়নায় তাকালো সে, নিজের দৃষ্টিতে একটা ভিন্ন আগুন খুঁজে পেলো।
"না… সব কিছু শেষ হয়নি… আমি যাবো… আর তৃষা... আমান... সবাইকে মনে করিয়ে দিবো, আরিয়ান এখনও বেঁচে আছে।"
—তার চোখে এখন আর কেবল ব্যথা নেই, সেখানে প্রতিজ্ঞা।
ভাঙা হৃদয়ের ভেতর জমা হচ্ছে এক ভয়ানক আগুন।
কিন্তু হঠাৎ করে বুজতে পারলো সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু কোনো লজ্জা নেই চোখে মুখে। বুজতে বাকি রইলো না যে তৃষার প্রতি ভালবাসা এতটাই বেশি অনুভব হচ্ছে তাই এমন হচ্ছে। তখনি মনে পড়ে গেলো হেনার কথা।
নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল আরিয়ানের।
চলবে.....