আরিয়ান ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে—কেউ তাকে ঠিকমতো লক্ষ্যও করছে না—তবে তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও তৃষার দিক থেকে সরছে না। সে দেখছে, অনুভব করছে… নিজের হৃদয়ের প্রতিটি ভাঙা টুকরো যেন আরও গভীরভাবে কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে।
স্টেজে দাঁড়িয়ে মিস্টার আমান একবার তৃষার দিকে তাকালেন, তারপর হালকা গলায় বললেন—
"সবাইকে বলি, এ আমার স্ত্রী—তৃষা।"
"আমার জীবনের নতুন পথচলার সঙ্গী।"
একজন একজন করে সামনে এসে তাদের শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, হাসির শব্দ, ছোট ছোট কথোপকথন—সব কিছুতেই তৃষাকে ঘিরে এক নতুন পরিচয়ের স্বীকৃতি।
তৃষা একটু লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু তার চোখের কোণেও যেন খোঁজ ছিল কারা কারা তাকে দেখছে। আরিয়ানের চোখের দৃষ্টি ঠিক কতটা তীক্ষ্ণ, সে যেন টের পেয়েছিল।
আমান তখন পাশে দাঁড়িয়ে এক হাত হালকা করে রাখলেন তৃষার পিঠে।
তৃষা একটু কেঁপে উঠলো, কারণ সে কখনোই এমন স্পর্শে অভ্যস্ত ছিল না।
আরিয়ান সেই মুহূর্তেই দেখতে পেল—তৃষা একটু পিছিয়ে গেলেও আবার নিজের জায়গায় এসে দাঁড়াল। আমানও খেয়াল করলো সেটা, কিন্তু কিছু বললো না।
আরিয়ানের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো, ঠোঁট কামড়ে ধরে ভিড়ের ভেতরেই ফিসফিস করে বললো—
"তৃষা… সত্যিই তুমি এই জায়গাটার জন্য তৈরি ছিলে?
তবে কেন তোমার চোখে এখনো এত অচেনা ভয়?"
সেই মুহূর্তে আরিয়ান পেছন ফিরে বেরিয়ে যেতে চাইল… কিন্তু তার পা যেন আটকে গেছে মাটিতে। কিছু একটা তাকে বারবার বলছে—"এই গল্প এখনো শেষ হয়নি।"
তৃষার চোখ ছুটে গেল এক জায়গায়—একজোড়া চোখ, যেগুলোর গভীরতা একসময় তার সব কিছু ছিল।
আরিয়ান।
ভিড়ের মধ্যে হলেও সেই চেহারা, সেই চাহনি তাকে এক মুহূর্তেই কাঁপিয়ে দিল।
তৃষার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো—অভিমান, রাগ, অপমান… সবকিছু একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকের ভেতর।
হঠাৎই সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললো।
চোখ সরাতে না পারা সেই যন্ত্রণার মাঝে, হঠাৎ তৃষা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার আমান-এর হাতটা জোরে ধরে ফেললো—কঠিনভাবে, যেন সেই স্পর্শ দিয়ে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দিতে চাইছে।
আর হাত ধরে রেখে সরাসরি তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের চোখে।
আরিয়ানের ভেতর এক মুহূর্তে ঝড় বয়ে গেল।
তৃষার সেই চাহনির ভাষা—অভিমানের সঙ্গে রাগ, চ্যালেঞ্জ, আর অদ্ভুত এক কান্না যেন একসাথে ফুটে উঠেছে।
আরিয়ান চোখ সরাতে পারলো না।
তার বুক ধকধক করছে—তৃষার হাতে ধরা আমানের হাতটা দেখে নিজের বুকের হাড়গুলো যেন চিড়চিড় করে ভাঙতে লাগলো।
সে অন্ধকার কোনায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু চোখে পানি জমে গেছে।
ঠোঁট চাপা দিয়ে, নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো—
“তুমি হারিয়ে গেলে… কিন্ত আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি তৃষা…”
আরিয়ানের বুকটা যেন ভেতর থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
তৃষার সেই আচরণ—মিস্টার আমানকে প্রকাশ্যে, সবার সামনে এমনভাবে ধরে রাখা—এটা শুধু দৃষ্টিতে নয়, অনুভবেও এক ধরনের দহন জাগিয়ে তুললো ওর ভেতরে।
তৃষা কেন করলো এটা?
ও কি বুঝিয়ে দিলো সে এখন আমানের?
আরিয়ানের চোখ এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো। কিন্তু ঠিক তখনই—
মিস্টার আমান খেয়াল করলেন।
তৃষার চোখের দিক অনুসরণ করে তাকাতেই চোখে পড়লো আরিয়ান।
ভিড়ের মধ্যেও, এত মানুষের ভেতরেও, তাকে আলাদা করে চিনে নিতে ভুল হলো না আমানের।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন তিনি।
তৃষার হাত এখনো তার হাতে, কিন্তু চোখ আরিয়ানের দিকে স্থির।
মিস্টার আমান তৃষার চাহনি, তার হাত ধরে থাকা আর আরিয়ানের হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে—সবকিছু মিলিয়ে গভীরভাবে অনুভব করলেন এক অদৃশ্য উত্তাপ।
তৃষার কণ্ঠে কিছু বলার ইচ্ছা নেই, কিন্তু তার দৃষ্টি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
হঠাৎ আমান নিচু গলায় তৃষাকে বললেন,
“তৃষা, বিয়ের আগে আমাদের যে চুক্তি হয়েছিল… এখন কি তুমি চাও ওকে সেটা জানানো হোক?”
তৃষা থমকে গেল।
চোখ বড় হয়ে তাকালো মিস্টার আমানের দিকে।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… তারপর ধীরে গলা নামিয়ে বলল,
“এখন না… এখন এই সব নিয়ে ভাবতে চাই না।”
তার গলায় কাঁপুনি ছিল, চোখের কোণে এক বিন্দু জমে থাকা অভিমান।
আরিয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে… সাবধানী, অস্থির, একা।
সে ভিড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করছে, মিস্টার আমানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে যেন কথা বলতে চায়।
কিন্তু নিরাপত্তা কর্মীরা, আমন্ত্রণ জানানো মানুষদের ভিড়, এবং পরিস্থিতির আনুষ্ঠানিকতা—সব মিলে বারবার তাকে আটকে দিচ্ছে।
আরিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে মুষ্টিবদ্ধ হাতে ভেতরের রাগ চেপে রাখলো।
“আমার কথা শোনাও যাবে না আজ?”
তার মুখে ভাঙা ভাঙা হাসি। চোখে যেন অন্ধকার।
তৃষা একবার তাকালো আরিয়ানের দিকে, তারপর চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
মনে হলো, সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না।
মিস্টার আমান এই দৃশ্য পুরো বুঝতে পারলেন।
তার দৃষ্টি একবার তৃষা, একবার আরিয়ানের দিকে।
অভ্যন্তরে হয়তো একটা খেলাই শুরু হলো—কেউ হারেনি এখনো, কিন্তু কেউ শান্তও নয়।
চলবে......