Posts

বিশ্ব সাহিত্য

এডগার অ্যালান পো'র গল্পে প্রতারক আর মিথ্যাবাদীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ - The Tell-Tale Heart

July 14, 2025

মো; আহসান-উজ-জামান

Original Author এডগার অ্যালান পো

73
View

এডগার অ্যালান পো একটা গল্প লিখেছিলেন, ছোট্ট একটা গল্প। সেই গল্পে কারো নাম ছিল না।


 যার জবানিতে গল্পটা এগোয় সে শুরুতেই আমাদের আশ্বস্ত করতে চায় যে সে উন্মাদ নয়, ভুলভাল দেখছে না-শুনছে না-বকছেও না, যদিও তার কন্ঠে ভয়ের ছাপ প্রবল। বুঝিয়ে বলে, আরে, ভয়ের জন্যই তো তার ইন্দ্রিয় সেতারার তারের মত টানটান হয়ে আছে, আলতো ছোঁয়াই তার কাছে এখন ঝংকার। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমস্ত গুঞ্জন যেন ঢেউয়ের মত তার কানে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। 

ভীত কন্ঠেই গল্প শোনানো শুরু করে সে।

মনে পড়ে না দুষ্টবুদ্ধিটা কখন তার মাথায় ঢুকলো। এমন না যে বুড়োর সম্পত্তির প্রতি তার কোন লোভ ছিল। বুড়োকে সে অনেক পছন্দ করতো, বুড়োও তাকে নিজের মনে করেই আগলে রাখতেন। কিন্তু বুড়োর চোখ দুটো সে সহ্য করতে পারতো না - ঠান্ডা নীল চোখ, যেন শকুনের মত অন্তরাত্মা পর্যন্ত সব দেখে নিচ্ছে, মনের সব খবর পড়ে নিচ্ছে। ভয় হয়, নিজের অজান্তেই কী কোন সত্য জেনে গেলো? নাহ, এভাবে তো চলতে পারে না। এই চোখ থেকে তার মুক্তি চাই।

স্রেফ নজর এড়াতে জান কবচ? এ কেমন কথা, পাগল হয়ে যায় নি তো! সে আবারো আমাদের আশ্বস্ত করতে চায়, তার মাথা বিগড়ায় নি। বলতে থাকে, দেখো, কি সুন্দর পরিকল্পনা ছিল আমার, কোন খুঁত রাখিনি, ধরা পড়ার কোন উপায়ই নেই। মাথা বিগড়ে গেলে কি এত সুন্দর পরিকল্পনা করতে পারতাম? উৎফুল্ল চিত্তে বলে চলে কিভাবে সে পুরো সপ্তা অপেক্ষা করেছে, বুড়োর সন্দেহ না জাগিয়ে তাকে নজরে রেখেছে,  বুড়োর ঘুমের মাঝেই তার ঘরে যেয়ে ঘুরে এসেছে। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নি। না, বুড়ো তাকে দেখে ফেলেনি, বুড়োর চোখ বন্ধই ছিল। কিন্তু চোখ না খুললে তো তাকে মারতে পারছে না, সেই ধারালো অন্তর্ভেদী চোখ ই তো আসল কালপ্রিট। সে নিশ্চিত হতে চায়, চোখের আলো নিভে যাওয়া স্বচক্ষে দেখতে চায়। বুড়োর প্রতি তো তার কোন রাগ নেই, কিন্তু এই চোখের অস্তিত্ব সে রাখবেই না। এই চোখের দৃষ্টির সামনে সে বারবার ধরা পড়ে যায়, নিজেকে নগ্ন মনে হয়, অস্থিমজ্জা হিম হয়ে আসে।


কালিগোলা অন্ধকারের মাঝেই বুড়ো একদিন টের পেয়ে যায়, ঘুম থেকে উঠে বসে হাঁক দেয়, কে ওখানে? কোন আওয়াজ আসে না। অন্ধকারেই শুয়ে থাকে বুড়ো, ভাবে কোন ইঁদুর হয়তো ছুটোছুটি করছে, কিংবা ফড়িং পাখা ঝাপটাচ্ছে-কিন্তু মন মানে না।

এদিকে সে আমাদের মনে করিয়ে দেয় তার তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয়ের কথা, ভয় যাতে নিয়মিত শান দিয়ে চলেছে। তার কানে ধরা পড়ে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে মৃদু টিকটক আওয়াজ - অনেকটা ঘড়িকে তুলোয় পেঁচিয়ে রাখলে যেমনটা শোনা যায়। সে বুঝতে পারে, দূর থেকে ভেসে আসা দ্রুতলয়ের আওয়াজটা বুড়োর হৃদপিন্ডের - ভয় পেয়েছে বুড়োটা। চিন্তাটাই মাথায় আসতেই আরো ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে সে, আওয়াজটাকে মনে হচ্ছে এখন যুদ্ধের দামামা।

আরে! ধুকপুকানি তো দেখি বেড়েই যাচ্ছে, বুক ফেটে মারা যাবে না তো! নতুন চিন্তা পেয়ে বসলো তাকে - যদি প্রতিবেশিরা শুনে ফেলে? লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সে, মুখ চেপে ধরে নিকেশ করে দেয় বুড়োটাকে কেউ টের পাওয়ার আগেই। হ্যাঁ, এবার থেমেছে আওয়াজটা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। কেটেকুটে বুড়োটাকে ঘরের একেক কোণায় লুকিয়ে রেখে দেয়। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই খুশি হয়ে যায়। আবারো মনে করিয়ে দেয় আমাদের, উন্মাদ হয়ে যায় নি সে, হলে কি এত সুন্দর বুদ্ধি করে সব প্রমাণ গায়েব করে দিতে পারতো?

সকাল হতেই দরজায় ঠকাঠক - পুলিশ হাজির। প্রতিবেশী কে যেন চিৎকার শুনেছে, সরেজমিন দেখতে চলে এসেছেন তারা। ভয় পায় না আমাদের কথক, হাসিমুখে স্বাগত জানায়, আপ্যায়ন করে। চেয়ার পেতে দেয় মেঝের যেখানে বুড়োর খন্ডিত শরীর লুকিয়ে রেখেছে ঠিক তার উপর, খোশগল্পে মেতে ওঠে সহাস্যে। আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছে সে। পুলিশও সন্তুষ্ট।

কিন্তু না, মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে তার। মাথাটা ঝাঁকালো কয়েকবার, যেন ঝেড়ে ফেলতে চাইছে কিছু। ঝিমঝিম ভাবটা এখন মৃদু গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে, থামাথামির লক্ষণ নেই। আওয়াজটা কেমন যেন চেনা ঠেকছে, ঘড়ির আওয়াজের মত না অনেকটা? টিকটক টিকটক। জোরে দম নিতে শুরু করলো সে, যেন তাতে শব্দটা চাপা পড়ে যাবে, পুলিশ কিচ্ছুটি টের পাবে না। যাচ্ছে না কেন এখনো ব্যাটারা? কি দরকার ছিলো এত খোশগপ্পের। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াতে লাগলো, শব্দটা চাপা দিতে চাইছে। আরে, আওয়াজটাও দেখি পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। মনে মনে কাকে যেন গাল দিলো, অসহায় একটা রাগ দলা পাকিয়ে উঠছে ভিতরে। ছুটে এসে চেয়ার মাটিতে ঘসে ঘসে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো, যেন তাতে দুনিয়ার সব শব্দ চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু আওয়াজটা যেন ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বব্রক্ষান্ডে-অন্তরীক্ষে।

আরে, পুলিশগুলো চুপচাপ বসে আছে কেন? হাসিমুখে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছে - এরা কি কিছু শুনতে পাচ্ছে না? না, এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই তারা শুনেছে। তারা কি আমাদের কথককে দেখে মজা নিচ্ছে? তার যাতনা কি তাদের কাছে বিনোদন? ওদের বাঁকা হাসি আর সহ্য হচ্ছে না তার, গগনবিদারী আওয়াজটাও যেন তার অস্তিত্ব পুরোটাই দখল করে নিচ্ছে। এ থেকে সে মুক্তি চায়।

চিৎকার করে মেঝের একের পর এক তক্তা উপড়ে ফেলতে থাকে সে। বুড়োর হৃদপিন্ডটা বের করে হাতে নিয়ে বিলাপ করে ওঠে, আর পারছি না আমি, কেউ এর গর্জনটা থামাও!

প্রতারক কিন্তু জানে সে মিথ্যাবাদী। সে সর্বদাই তটস্থ, পাছে কেউ জেনে ফেলে তার নিগুড় সত্য। তার ভয় আর আতংকই তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করবে যা তাকে ঠেলে নিয়ে যাবে খাদের কিনারায়, সে বুঝতেও পারবে না সে কী করছে।

সেখান থেকে কোন মিথ্যাবাদী কখনও ফিরে আসে নি।

ArtStation - The Tell - Tale Heart



 

Comments

    Please login to post comment. Login