মিস্টার আমান এক মুহূর্ত চুপ করে আরিয়ানের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
— “আরিয়ান, আজকের এই অনুষ্ঠানটা আমার দাদি মার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই না আজ কোনো রকম ঝামেলা হোক। আপনি যদি নিজেকে সামলে রাখতে না পারেন, তাহলে দয়া করে বাসায় ফিরে যান। প্লীজ।”
আরিয়ান থমকে গেল। চোখে একরাশ ব্যথা, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। গলার ভেতর জমে থাকা কথাগুলো গিলে ফেলতে হলো।
তার শুধু মনে হলো, এই এক মুহূর্তে তৃষা যেন আরও দূরে সরে গেল তার থেকে—অথচ কিছু বলার ছিল, অনেক কিছু।
সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে পেছন ফিরতে লাগলো… আর মঞ্চে বসে থাকা তৃষা ভিড়ের ফাঁক দিয়ে দেখে ফেললো সেই দৃশ্য।
তার বুকেও হালকা কাঁপুনি উঠলো, কিন্তু কিছু বলার ছিল না, কিছু বলার অধিকারও আর ছিল না।
আরিয়ানের বুকটা কেঁপে উঠলো, চোখ ভিজে এল। কিন্তু সে জানে… কিছু বললেই ভেঙে পড়বে।
তাই চোখ নামিয়ে চুপচাপ চলে গেলো, মুখে একটাও শব্দ না করে।
তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, মুখটা কঠিন করে তুলে নিলো। একবার চোখ ঘুরিয়ে শেষবারের মতো মঞ্চের দিকে তাকালো—
তৃষা তখন কারও সাথে কথা বলছিল, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখ আটকে গেল।
তৃষা চোখ ফিরিয়ে নিলেও, আরিয়ান সেই এক ঝলকেই বুঝে ফেললো—সব কিছু শেষ হয়ে গেল।
তৃষা ওর চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো, তারপর যেন ধাতস্থ হতে পারলো না।
মনে-মনে ভাঙতে লাগলো—
"আমাকে দেখে কিছু বললো না…? আমি কি এতটাই পর হয়ে গেলাম ওর কাছে?
তবে কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতো না? তাই তো বিয়ের রাতে উধাও হয়ে গেল…
তাই তো আজ এত সহজে পাশ কাটিয়ে চলে গেল…"
তৃষার মুখটা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেল। এত লোক, এত আলো, এত আয়োজন—সব অস্পষ্ট হয়ে উঠলো চোখে।
হৃদয়ের ভেতর কান্না জমে ছিলো অনেকদিন, আজ যেন সব বেরিয়ে এলো।
চুপচাপ একটা কোণে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলো তৃষা…
একটা বেদনার অভিমান চেপে বসেছে তার বুকের উপর।
বাহিরে যেন উৎসব, আর ভেতরে শুধু ভাঙনের সুর…
তৃষা ভাবতে লাগলো—
"ভুল কি আমারই ছিল?"
এদিকে আমান সব কিছু লক্ষ্য করছিল দূর থেকে…
চোখে যেন একটা নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা ঝিলিক দিয়ে উঠলো
আরিয়ান মনে মনে তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছিল, কিন্তু আমানের কথাগুলো তাকে যেন বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনলো। এমনিতেই রাতে কিছুটা ড্রিঙ্কস করেছে—সেজন্য মাথাও ভার লাগছিল। সে জানতো, আর এখানে থাকলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।
চুপচাপ, ভারী পায়ে, ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল অনুষ্ঠানস্থল থেকে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস যেন মাথা একটু ঠান্ডা করলো, কিন্তু হৃদয়ের ভেতরের ঝড় থামলো না।
একটা সাদা গাড়িতে উঠে বসে আরিয়ান নিজেই ড্রাইভারকে বললো, “চলো… কোথাও নিয়ে চলো… যেখানে কেউ নেই…”
ড্রাইভার বুঝে গেল, আজ কথা বলা যাবে না। গাড়ি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে…
আর পেছনে রয়ে গেল এক অপূর্ণ ভালোবাসার গভীর দহন।
চলবে.........