গাড়ির ভেতরে নিস্তব্ধতা। রাতের আলো-অন্ধকার মিশে যেন এক বিষণ্ন চাদরে মুড়ে রেখেছে আরিয়ানকে।
আরিয়ান জানালার বাইরে তাকিয়েই হঠাৎ গলা নামিয়ে বললো,
— “আমার মদের বোতলটা দাও।”
ড্রাইভার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে পাশের আসনের নিচ থেকে বোতলটা বের করে দিলো। কিছু বললো না। শুধু একবার তাকালো তার বসের দিকে—কোনোদিন এমন দেখেনি তাকে।
মনে মনে বললো,
“কি থেকে কি হয়ে গেলো... এই মানুষটা তো একদিন হাসতেন, স্বপ্ন দেখতেন।
আজ চোখে শুধু হেরে যাওয়ার ছায়া।
এই মানুষটা তো এমন ছিল না…”
আরিয়ান বোতলটা নিয়ে মুখে ঠেকিয়ে এক চুমুক দিলো, চোখ বন্ধ করে রাখলো কিছুক্ষণ।
মনের ভেতর তৃষার মুখ… তৃষার সেই মলিন চোখ… সেই কান্না চাপা অভিমান…
সব যেন আরো জ্বালিয়ে তুলছে তাকে।
কণ্ঠটা ভারী হয়ে উঠলো, বুকটা ধুকপুক করছে অজানা কষ্টে।
গাড়িটা চলতে থাকলো, আরিয়ানের ভেতরে যেন আরও গভীর অন্ধকার জমে উঠলো।
কেউ জানে না, সেই অন্ধকারে আজ কোন যুদ্ধ চলছে।
শুধু বোতলের ভেতর ঢালছে বিষ, আর বাইরে থেকে মানুষটা নিঃশব্দে গলে যাচ্ছে…
ড্রাইভার কিছু না বলে নিজের মতো করে গাড়ি চালাতে থাকলো। বাইরের আলো-ছায়া গাড়ির কাঁচে ঝাপসা হয়ে আসছিল, আর ভিতরে বসে থাকা আরিয়ানের চোখে ছিল শুধুই শূন্যতা।
আর সেই সময়… অন্যদিকে, রিসিপশনের ঝলমলে আলো, অতিথিদের হাসিমুখ, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ—সবকিছুর মাঝেও তৃষার মনটা যেন বারবার ভার হয়ে উঠছিল। একটা অজানা অস্থিরতা ওর বুকের ভেতর ঢেউ তুলছিল।
আরিয়ান…
ওর মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল তৃষার মনে। সেই চেনা চোখ, সেই কষ্ট চেপে রাখা দৃষ্টি…
তৃষা ভাবতে লাগলো,
“কেনো গেলো এমনভাবে?
কিছু না বলে… একবারও না তাকিয়ে…
ভুলে গেছে?
ভালোবাসে না আর?”
তৃষার বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো। ঠোঁট কেঁপে উঠলো, চোখে জল জমে উঠলো…
নিজের অজান্তেই ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছিল আমানের হাতটা।
মিস্টার আমান সব বুঝতে পারছিলেন, তৃষার সেই নিরব ভাঙন। তিনি একটু চুপ করে তাকালেন তৃষার দিকে।
তারপর নিজেকে সামলে, দম নিয়ে মনে মনে বললেন,
“দাদি… আপনি তো বলেছিলেন, সময় সব ঠিক করে দেয়।
কিন্তু আপনি যে আমাদের এমন এক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে গেছেন,
যেখানে ভালোবাসা, অভিমান, আর বেদনার চাপে সবকিছু ভেঙে যাচ্ছে…
এই মেয়েটা কি কখনো আমাকে আপন করে নিতে পারবে?”
অবচেতনেই আমান আরেকটু কাছে সরলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
শুধু পাশে থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
আজ রাতে, এত মানুষের মাঝেও—তৃষা, আরিয়ান, আমান—তিনজন তিনভাবে একা।
ভিন্ন ভিন্ন অনুভবে গলে যাচ্ছে,
ভালোবাসার, ত্যাগের, আর অসম্পূর্ণতার অদৃশ্য আগুনে।
এই রাতে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস জমে থাকলো বাতাসে…
অপূর্ণ প্রেম আর নতুন জীবনের মাঝখানে।
দাদি দূর থেকে আমান আর তৃষাকে একসাথে স্টেজে বসে থাকতে দেখে অপলক তাকিয়ে রইলেন। চারপাশে অতিথিদের আনন্দ, হেসে কথা বলা, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ—সবকিছুর মাঝেও দাদির চোখ আটকে ছিল সেই দুই মুখে।
তৃষা পরেছিল দাদির পছন্দ করা সবুজ শাড়ি, গলায় সেই দুর্লভ সবুজ ডায়মন্ড সেট, যা দাদি বহু বছর আগে নিজের বিয়ের সময় পেয়েছিলেন। আজ তৃষার গায়ে ওসব দেখে দাদির চোখ যেন অতীতে ফিরে যাচ্ছিল।
তিনি আশেপাশের সবাইকে আনন্দে বলতে লাগলেন—
“দেখো তো আমার পোতা আর পোতা বৌকে! কী মানিয়েছে না বলো? আল্লাহ্ যেন তাদের সব সুখ দেয়। নজর না লাগে… মাশাআল্লাহ!”
তার গলায় কাঁপা কাঁপা আবেগ, মুখে তৃপ্তির ছায়া, আর হঠাৎ করেই চোখে পানি এসে গেলো।
তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিলেন চুপচাপ।
আসলে দাদির এই চোখের পানি শুধু আনন্দের না—
তার ভিতরে ছিল অনেক কষ্ট, অনেক প্রার্থনা, আর একটা চাওয়া—
“যেন এই সম্পর্কটা টিকে যায়…
যেন তৃষা সত্যি সত্যিই একদিন আমানকে ভালোবাসে…
আর আমার পোতা… সে যেন সত্যিই তৃষার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য হয়।”
লোকজন যখন দাদির কথায় হেসে সায় দিচ্ছিল, তখন দাদির চোখ ছিল আরেকবার তৃষার মুখে…
সেই মুখে যেন কোথাও একটা ছায়া…
যেটা কেবল একজন দাদি-মন বুঝতে পারে।
তবে আজ, তিনি শুধু আনন্দটাই দেখতে চাইলেন।
হয়তো তাঁর নিজের চোখে দেখা বহু অসম্পূর্ণ গল্পের শেষে আজ তিনি একটা পূর্ণতা দেখতে চাইছিলেন…
আর সেখানেই সেই একফোঁটা চোখের জল—
আনন্দ, আশঙ্কা আর দোয়ার এক মিশ্র ভাষা।
চলবে....