রাত তখন গভীর—চারদিক ফাঁকা রাস্তা, দোকানপাট সব বন্ধ, শহরটা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই নীরবতার ভেতর দিয়ে গাড়ির হালকা গতি আরিয়ানের ভাঙা মনের মতোই থেমে থেমে চলছিল।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে একটানা শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। মুখে কথা নেই, চোখে ঘোলা দৃষ্টি, একহাতে সিগারেট ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল।
ড্রাইভার ধীরে ধীরে বলল,
“স্যার, পুরো শহরটাই ঘুরে ফেললাম। এখন কী করব?”
আরিয়ান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমাকে সেই পার্কে নিয়ে চল… যেখানে তৃষাকে নিয়ে যেতাম… যেখানে ওর হাসির শব্দে পুরো রাত আমার জন্য জ্যোৎস্নাময় হয়ে যেত।”
ড্রাইভার একটু থমকে বলল,
“স্যার, এখন রাত ১১:৩০… এই সময় তো পার্কে ঢুকতে দেবে না…”
আরিয়ান ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালো। সেই চাহনিতে ছিল হতাশা, ক্লান্তি, আর একরাশ ব্যথা—একটা ভাঙা মানুষের নিরব তর্জন।
রাগে না, দুঃখে—তবু চোখে তীব্রতা ছিল।
ড্রাইভার মাথা নিচু করে বলল,
“ঠিক আছে, স্যার…”
তারপর সে গাড়ি ঘুরিয়ে সেই পার্কের দিকে রওনা দিল।
আরিয়ান মনে মনে ভাবতে লাগলো,
সেই পার্ক…
যেখানে ছিল তাদের শত স্মৃতি,
অনেক অন্তরঙ্গ মুহূর্ত,
যেখানে তৃষার মুখের সামনে আরিয়ান নিজেকে বারবার খুঁজে পেয়েছিল।
আজ সেই একই রাস্তা, কিন্তু পাশে কেউ নেই।
শুধু একটা হৃদয়, যার সব আবেগ আজো আটকে আছে অতীতের এক কোণে—
যেখানে তৃষা এখন শুধুই স্মৃতি, আর নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে এক নিঃসঙ্গ প্রেমিক…
রাত তখন আরও গভীর…
শহরের নিস্তব্ধতা যেন সাক্ষী হয়ে রইল এক অদৃশ্য কান্নার।
অনুষ্ঠানটা ধীরে ধীরে শেষের দিকে এগোচ্ছিল। চারদিকে আলো ঝলমল, ক্যামেরার ঝিকিমিকি আর হালকা বাজনার মাঝে একটা ধরণের পরিণতির ছায়া নেমে এসেছিল।
তৃষার বাবা, মা, চাচা-চাচী, ফুফু—সবাই একে একে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। কেউ চোখে পানি আটকে রাখতে পারল না।
তৃষার মা মুখে হাত রেখে বললেন,
“আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেল, নতুন জীবনে পা রাখছে… আল্লাহ তোমার জীবন সুখের করে দিক মা।”
বাবা কাঁপা কণ্ঠে শুধু বললেন,
“ভুলেও ভেঙে পড়বি না… সাহসী থাকিস।”
সবার ভালবাসা আর আশীর্বাদের মাঝে তৃষার চোখে জল টলমল করছিল। তবে সেই চোখের জল কেবল খুশির ছিল না—তার ভিতরে ছিল একরাশ হাহাকার।
হঠাৎ চাচা তৃষার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গেলেন।
গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“মা, আমি আগেও তোকে বলেছি, এখনো বলছি—আরিয়ান ভালো ছেলে হতে পারে, কিন্তু ও তোকে শান্তি দিতে পারবে না। তোর জন্য ও ঠিক না।”
তৃষার চোখের জল আর আটকে রাখা গেল না। টুপ করে পড়ে গেল গাল বেয়ে।
চাচা তৃষার কাঁধে হাত রেখে আদর করে বললেন,
“মনটা শক্ত করে মা। এখন যেই পরিবারে যাচ্ছিস, ওরা অনেক ভালো। মানুষগুলো খুব আন্তরিক। কখনোই তাদের অযত্ন করিস না। তোকে অনেক ভালোবাসবে।”
তৃষা মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে। মুখে কিছু বলল না, শুধু চোখ নামিয়ে রাখল।
কিন্তু মনটা তখন তীব্র এক ঝড়ে আচ্ছন্ন।
আরিয়ান, ওর সেই নীরব চলে যাওয়া, আর একটাবারও না তাকানো—সবকিছু একসাথে তৃষাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছিল।
এরপর একে একে সবাই বিদায় নিতে শুরু করলো।
কারো চোখে হাসি, কারো চোখে জল।
আর তৃষা?
তৃষা দাঁড়িয়ে রইল, চোখে একরাশ ধোঁয়াটে অনুভব নিয়ে।
একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল, আরেকটা শুরু হলো।
কিন্তু তৃষার ভিতরে যেন সবকিছুই থমকে রইল।
নতুন জীবনের শুরুতে, তৃষার মন জুড়ে ছিল শুধুই এক পুরোনো প্রেমের অসমাপ্ত গল্প…
চলবে.......