গভীর রাত, পার্কের চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল গেটের পাশে আলোটা জ্বলছে ম্লানভাবে। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সিকিউরিটি গার্ড আর আরিয়ানের ড্রাইভার।
গার্ড: (চোখ কুঁচকে দেখে)
— তোমার স্যার তো বেসামাল রে ভাই। এভাবে চললে যে কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে।
ড্রাইভার: (হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
— জানি ভাই, কিন্তু আমার কথার উপরে ভরসা করে গেটটা খুলে দিলা, এজন্যই কৃতজ্ঞ। তুমি তালা দিয়া রাখো বাইরে থেকে। আমি গাড়িটা একটু সামনে রেখে আসি, যাতে মানুষ খালি গেট না দেখে ঢুকে না পড়ে।
গার্ড:
— আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু বল তো, এমন কী হইল যে তিনি এতটা ভেঙে পড়ল?
ড্রাইভার: (কণ্ঠ ভারী করে)
— কাহিনী অনেক বড় ভাই। স্যার খুব ভালো মানুষ, জানো? তার ভালবাসার মানুষের সাথে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। বিয়েও ঠিক হয়েছিল তাদের… কিন্তু বিয়ের দিনই সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে।
গার্ড: (চোখ গোল করে)
— কি বলো! বিয়ের দিন! কেমনে সম্ভব?
ড্রাইভার:
— সম্ভবই তো হইছে। সেই অনুষ্ঠান থেকেই আসছি আমরা। সে যে কীভাবে নিজেকে সামলে রাখছিলো, আমি চোখে দেখছি।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে... পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে স্যার। মুখে না বললেও চোখে যে যন্ত্রণাটা আছে, তা গোপন করা যায় না।
গার্ড: (চুপচাপ মাথা নাড়ে)
— আহা… জীবনও কি না নাটকরে ভাই। বাইরের মানুষ দেখে বোঝে না কত বড় ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কেউ কেউ।
ড্রাইভার:
— ঠিক কইছো। স্যার এখন পার্কের ভেতর একা বসে আছে। এই পার্কে ওর আর সেই মেয়েটার কত স্মৃতি… হয়তো সেইগুলোই মনে পড়ছে বারবার।
গার্ড:
— ভালোবাসা মানুষকে গড়ে তো তোলে, আবার ধ্বংসও করে দেয়। তুমি গাড়িটা রেখে আসো ভাই, আমি গেটটা তালা দিই। কেউ যেন স্যারের এই অবস্থা না দেখতে পায়।
ড্রাইভার: (চোখ নামিয়ে বলে)
— হ্যাঁ ভাই। শুধু প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন ওর মনটা একটু শান্ত করেন… এই মানুষটা এমনটা ডিজার্ভ করে না।
আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানুষের কথোপকথনে যেন রাতটা আরও ভারী হয়ে ওঠে। ভেতরে একা বসে থাকা আরিয়ান অন্ধকারে তাকিয়ে আছেন—যেখানে শুধুই স্মৃতি আর কষ্টের ছায়া…
আরিয়ান লেকের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রাতের আকাশে চাঁদ নেই, কেবল গাঢ় অন্ধকার। লেকের পানিটাও যেন সেই অন্ধকারকে বহন করছে—নিঃশব্দ, গভীর আর শীতল।
তবুও আরিয়ানের চোখে কোনো ভয় নেই। পা দুটো সে ধীরে ধীরে পানিতে ডুবিয়ে রাখে, যেন সেই ঠান্ডা ছোঁয়াতেই জ্বালাগুলো একটু প্রশমিত হবে।
হঠাৎ করেই, অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো ঝলকে ওঠে মনে—
একটা পুরনো মুহূর্ত, একটা ফ্ল্যাশব্যাক।
তৃষার সাথে কাটানো সেই রাত।
চুপিসারে পার্কে এসেছিল তারা, ঠিক এই জায়গাটায়। তখনও পার্কটা খোলা ছিল, কিন্তু বন্ধ হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে ঢুকে পড়েছিল তারা। পার্কের লেকের পাশে, এই জায়গায়…
তারা দু’জন বসে ছিল পাশাপাশি, মাথার উপরে খোলা আকাশ।
আকাশে ছড়িয়ে থাকা তারা দেখে দেখে তৃষা হাসছিল, আর আরিয়ান চুপ করে তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে।
— "আরিয়ান, কল্পনা করো, একদিন আমরা নিজের একটা ছোট্ট বাড়ি করব। সামনের উঠানে এমন একটা লেক থাকবে,"
তৃষা বলেছিল সেই রাতে,
— "আর চারদিকে গাছ… আকাশ দেখে আমরা অনেক গল্প করব।"
আরিয়ান হেসে বলেছিল,
— "তখন তোকে কেউ বলবে না, 'পার্ক বন্ধ, চলে যান'!"
সেই কথার ঠিক পরেই, সেই রাতেও, এক গার্ড এসে বলেছিল,
— "এই যে, পার্ক বন্ধ! বের হয়ে যান সবাই!"
তখন তৃষা তাকিয়ে বলেছিল,
— "জাবো না।"
আরিয়ান একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, কিন্তু তৃষার চোখে ছিল একরকম জেদ আর সরল আবেগের মিশেল।
তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে, তৃষার হাত ধরে বলেছিল,
— "চল তাড়াতাড়ি, না হলে ধরা পড়ে যাব।"
তৃষা তখন মুচকি হেসে বলেছিল,
— "তুমি কি করছো?"
আর তার উত্তর না দিয়ে…
আরিয়ান হঠাৎ টেনে নিয়েছিল তৃষাকে।
পার্কের ভেতর, এক ঝোপের আড়ালে, যেখানে অনেক গাছপালা, অনেক ছায়া…
আর তখন…
সে তৃষাকে এমন করে জড়িয়ে ধরেছিল যেন তার পুরো অস্তিত্বটাই সেই স্পর্শে হারিয়ে যায়।
তৃষাকে দেখে মনে হয়েছিল…
একজন মানুষ, যার বুকের ভেতর একটা সমুদ্র চাপা পড়ে আছে।
যার ভালোবাসা ভাষায় বোঝানো যায় না।
যার ভেতরে কেবল একটাই নাম,
— তৃষা…
এরপর যা হলো.....
(চলবে...)