Posts

গল্প

এখানেই রয়েছে" চাপ"

July 16, 2025

প্রভাবতী

83
View

গল্প: চাপ
লেখক: প্রভাবতী

উহ! আয় হায়! "কী খারাপ!" "ভালো লাগে না।"

জীবনটা যেন দিনে দিনে মৃত্যুর মতো হয়ে যাচ্ছে পিয়ার কাছে। যত্রতত্র যন্ত্রণা—মন ও শরীরে। ডিসেম্বর মাসটা কেটেছে ক্লান্তিতে, চাপ আর হতাশায়। রেজাল্টের আগেই পিয়া হেসে খেলে চলতো, রেজাল্টের পর মুখ লুকিয়ে চলতে হয় তাকে। তার রোল ছিল ১০, কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে উঠেই রোল পড়ে গেল অনেক নিচে।

সেই থেকেই শুরু হয় পারিবারিক চাপের নতুন অধ্যায়।

আজ জানুয়ারির ৮ তারিখ। সরকারি বই পেয়েছে ১১টি, অথচ পুরো সেটে থাকা দরকার ছিল ১৪টি। বাকি তিনটা বই মজুত না থাকায় এখনো পায়নি পিয়া। মা ভীষণ রেগে গেলেন, বললেন, "যদি তোর রোল আগে থাকত তাহলে এই সমস্যা হতো?"

১০ তারিখে স্কুলে বেতনের রশিদ, বই জমা সহ অনেক কাজ করতে হয়েছে। মা সবসময় পিয়ার চোখে চোখে থাকেন, সেদিনও স্কুলে গিয়েছিলেন। তবে কাজগুলো শেষ করার সময় তার মাকে পিয়া গেটে বসিয়ে রেখে নিজের বান্ধবী পেখম-এর সঙ্গে কাজগুলো সারলেন। পিয়া দৌড়ে মাকে ধরতে গিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল কেন এত ছোটাছুটি করতে হয়েছে। কিন্তু মা একবারও পিছনে ফিরলেন না।

সেই পরিস্থিতি যেন এক অসহ্য বিরম্বনা। মা তখন ছোট্ট শিশুর মতো রেগে ছিলেন, পিয়ার মনে হয়েছিল, "মায়েরা কি কখনও বড় হয়?"

পরদিন বিকেলে পড়ার টেবিলে বসে গণিতের প্রথম অধ্যায় দেখতে দেখতে সে বলে উঠল, "মা, আমি এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছি। এবার একটু স্বাধীনতা কি পাওয়া যায় না? স্কুলে নিজে নিজে যেতে দিবে না আমাকে?"

মা বললেন, "না। যেদিন তোর রোল প্রথম হবে, সেদিনই যাবি একা।"

পিয়া দমে গেল না। "কিন্তু মা, ফার্স্ট হওয়া আর একা যাওয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক? আমি তো আর বাচ্চা না!"

মা দৃঢ়ভাবে বললেন, "পড়ালেখায় ভালো না হলে কোথাও একা যেতে পারবি না। মেধা দিয়েই পরিস্থিতি সামলাতে শিখতে হয়।"

পিয়া যুক্তি দিল, "কাপড় কাচা, স্কুলে যাওয়া—এসব সাধারণ কাজ। এতে তো অতিরিক্ত মেধা লাগে না!"

মা উত্তেজিত হয়ে বললেন, "লাগে। মেধা না থাকলে জীবনেও কিছু করতে পারবি না।"

পিয়া বলল, "তুমি প্রতিদিনই বলো—রোল একে না গেলে কিছু পাবে না। এমনকি যদি এক নম্বরে উঠে যাই, তখনও তুমি সেই কথা রাখবে না।"

এই কথায় মা আরো রেগে গেলেন, এবং পিয়াকে চড় মারলেন। বললেন, "তোর রোল ১ না হলে আমি তোর যে কোনো চাওয়া পূরণ করব ।"

কান্না চেপে পিয়া বলল, "তুমি কখনোই কথা রাখো না, মা।"

তারপর শুরু হলো এক অন্যরকম যাত্রা। সে পড়াশোনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল—রাত থেকে দিন, দিন থেকে রাত। কারো সঙ্গে কথা বলে না, খেলাধুলা নেই, হাসি নেই—শুধু বই আর বই।

পরিবারে আর্থিক অবস্থা সচ্ছল, কিন্তু টানাটানি থাকে। বাবা-মা পিয়ার ওপরই ভরসা করেন। ছোটবেলায় বাবার একবার রেগে গিয়ে তার মুখে বালিশ চাপা দেওয়ার ঘটনা তাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। সে তখন মাত্র সাত কি আট বছরের। মায়ের হস্তক্ষেপেই সে রক্ষা পেয়েছিল।

জানুয়ারি গেল, ফেব্রুয়ারি গেল, এপ্রিলেও পহেলা বৈশাখ পেরিয়ে গেলো কিন্তু পিয়ার জীবনে কোনো আনন্দ স্পর্শ করতে পারল না। একাকিত্ব, বিষণ্ণতা আর পড়ার চাপ তাকে পিষে ফেলে ধীরে ধীরে।

জুলাইয়ে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় হয়—১২০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ১১৯০! কিন্তু মা-বাবা সন্তুষ্ট নন। পিয়া এবার নিজেকে টর্নেডোর মতো বইয়ের ভেতরে গুটিয়ে ফেলল। জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ভেঙে যাচ্ছে—তবুও পড়া থামায় না সে।

শেষ পর্যন্ত ফাইনাল পরীক্ষার সময় প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থাতেও সে পরীক্ষা দিল। ফলাফলে সে তাক লাগিয়ে দেয়—১২০০-এর মধ্যে ১২০০ পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে।

মা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খুশিতে বলে উঠলেন, "আমার লক্ষ্মী মেয়েটা! সব দেবো তোকে, যা চাস সব!"

পিয়া চুপচাপ তাকিয়ে রইল। বলল, "মা... সত্যি?"

মা হেসে বললেন, "হ্যাঁ, একদম সত্যি।"

তবে সেদিন সন্ধ্যায় পিয়ার শরীর খারাপ হয়ে যায়—জ্বর আসে, কাঁপুনি ধরে। মা তার পাশে বসে বলেন, "কাল তোকে ঘুরতে নিয়ে যাব, তোর পছন্দের জায়গায়।"

পিয়া নিঃসঙ্গ গলায় বলল, "মা, সেদিনও বলেছিলাম, আজও বলছি—তুমি তোমার কথা রাখতে পারবে না।"

মা কেঁদে ফেললেন, "এই কথা আবার বলিস না।"

পিয়া মোবাইল চাইল। বন্ধুদের কল করল, কিন্তু পেখম কল ধরল না। সে সত্যিই রেগে আছে। পিয়া জানে, সে কষ্ট পেয়েছে পেখমকে উপেক্ষা করায়।

পিয়া ধীরে বলল, "মা, তোমার সেই কথা—যে এক হলে সব দেবে—তোমার মনে আছে? দেখো, আমি এক হয়েছি। এখন তুমি কথা রাখতে পারবে না।"

তারপর বলল, "ঘর থেকে যাও তো, মা। বাতিটা নিভিয়ে দিও।"

মা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। নিভিয়ে দিলেন বাতি। ঘর অন্ধকারে ঢেকে গেল। আর পিয়ার জীবনের আলো—সে নিভে গেল।

চলে গেল এমন এক জগতে, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। রেখে গেল চাপ, আশা, প্রতিযোগিতা, বেদনা, আর এক গভীর দীর্ঘশ্বাস।

এই প্রতিযোগিতার সমাজে সে জিতেছিল, কিন্তু বাঁচতে পারেনি। তার শেষ প্রতিপক্ষ ছিল—চাপ।

শেষ।

Comments