Posts

উপন্যাস

রুনা লায়লার সুর ও কিংবদন্তি অবলম্বনে গীতি-উপন্যাস "মায়ার সিংহাসন"- ৭

July 17, 2025

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

233
View
অলংকরণ: রাজীব দত্ত

পর্ব- ৭: পিয়া আয়ে না সারি রাত

গান শেষ হতেই উপস্থিত উৎসুক মানুষগুলো হাত তালি দিতে দিতে তাঁকে ঘিরে ধরল। এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এসে একটা সাদা খাম হাতে দিল। খুললে দেখা গেলো তিনটা একশ রুপির নোট।  কেন টাকা দিল? গান গেয়ে কেউ টাকা নেয়? ছি! 

অপমানে কেঁদেই ফেললেন শিল্পী। বাকিরা এবার ঘোর থেকে বের হতে বাধ্য হলো। নিখুঁত গায়কির মোহে তারা ভুলেই গিয়েছিল, এতোক্ষণ নিতান্তই ছোট্ট একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সামনে। এই শিশুকে এখন সহজ করে বুঝিয়ে বলতে হবে যে এই টাকা হলো একজন শিল্পীর অর্জন করা সম্মানি, লজ্জার কিছু নাই। মানুষের মন কতো বিচিত্র কায়দায় বেড়ে ওঠে! এতো জটিল সুরের খেলা যে বালিকা অভিজ্ঞ সাধকের মতো সমস্ত সত্তায় ধারণ করতে পারে, তাঁর  চারপাশের দুনিয়া এখনও কতো সরল সহজ!

এই তরুণতম গায়িকা পরের গান গাইতে আবারো লাহোর গেলেন। সপ্তাহ খানেক পরেই। এবারের গানটা আরো কঠিন। সুরে সূক্ষ্ম কিছু অলঙ্কার আশা করছেন সুরস্রষ্টা। তাঁর উপর গানটা দুঃখ-নির্ভর, বড়োদের বিরহ নিয়ে লেখা। এমন আবেগের ধারণ ও প্রকাশ এখনো তাঁর অজানা। তাহলে এই পরম কষ্টে পাওয়া কথাগুলো তিনি গাইবেন কী করে?

মিলতা নাহি সুকুন

হায়, ম্যায় কেয়া কারু

তবে হলো উল্টোটা। সবার আশঙ্কা ছিল গানের এমন গভীর অনুভূতিতে এই ছোট বালিকা ঢুকবে কী করে। কিন্তু গান শেষে দেখা গেল মেয়েটা আর সেই আবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সঙ্গীত পরিচালক “কাট” বলার পরেও বারবার সে ডুকরে ডুকরে গাইছে “হায়, ম্যায় কেয়া কারু”।

কেয়া হুয়া, বেবি? 

সুরস্রষ্টা ছুটে আসলেন কোক আর চকলেট হাতে। কিন্তু বালিকা শিল্পীর বুকভাঙা কান্না থামাতে খুব বেগ পেতে হলো তাঁকে‌। একটু মন খারাপ লাগলেও তিনি আদতে খুশি হলেন। এতো দিনের অভিজ্ঞতা যদি ভুল না বলে, এই মেয়ে একদিন দিগ্বিজয়ী গায়িকা হবে। কথাগুলোতে সুর বসানোর সময় কল্পনাতে তিনি যে দুঃখের ছবি দেখেছেন, এই শিশু সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। এক অমূল্য রত্নের খনি আবিষ্কারের আনন্দে চোখে জল তাঁর নিজের অজান্তেই দুলে উঠলো। 

মহান শিশু শিল্পী সেদিন হয়তো সুরের ভাঁজেই দুঃখের চিহ্ন পেয়েছিলেন। অথবা সাত বছর বয়সে ঘটে যাওয়া এক দুঃসহ রাতের স্মৃতি এসে তাঁকে গানের তালে কাঁদিয়ে গেছে। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে সেবার ভয়াবহ গরম পড়েছিল। ঘরের গুমোট ভাব কাটানোর জন্যে কয়েকটা দিন জানলা খুলেই ঘুমাতো বাড়ির সবাই। আমাদের সুরের রাজকন্যা ঘুমিয়েছিল একা। মেঝেতে আধখোলা চোখে শুয়েছিল পোষা কুকুরটা।  মাঝরাতে হঠাৎ একটা বিশাল ঠান্ডা হাত এসে নিজের হাতের উপর পড়লো বলে মনে হলো। চোখ খুলেই তিনি দেখলেন এক দুর্ধর্ষ চাহনির লোক বসে আছে বিছানার কোণায়। হাতে ধারালো ছুরি। নাক মুখ কাপড়ে ঢাকা। চোর বা ডাকাতকে দেখে তিনি চিৎকার দিতে যাবেন, এমন সময় লোকটা ছুরি ধরল একেবারে তার গলা বরাবর। ভয়ে এই তীব্র গরমেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অস্থিরতায় মনে হচ্ছে মুহূর্তেই দম বের হয়ে যাবে। 

হঠাৎ তাঁর প্রিয় কুকুর ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়ে এসে কামড় বসালো চোরের হাতে। ছুরি পড়ে গেল বিছানায়‌। এই সুযোগে দরজার দিকে তাকিয়ে “ড্যাডি” বলে চিৎকার দিল সে, যতো জোরে সম্ভব। বাবা মার ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনে একটু আস্বস্ত হয়ে ঘুরে তাকিয়েই আমাদের গানের রানি যে দৃশ্য দেখলেন, তা তাঁর মন থেকে কোনদিন আর মোছা যাবে না। চোখ দু'টোতে যেন তৎক্ষণাৎ আগুন লেগে গেল। পুড়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তিনি দেখলেন রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর নিয়ে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ঢলে পড়ছে মেঝের উপর। প্রিয় কুকুরের গোঙানির শব্দ এসে তাঁর বুক ছিদ্র করে অজানা কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।

এই দুঃখই তাঁর বলার মতো একমাত্র দুঃখ ছিল অনেক দিন। তেরো বছর বয়সে যে গান গেয়ে তিনি দুই প্রদেশ মাতোয়ারা করে রেখেছিলেন মাসের পর মাস, সেখানেও এইরকম গহীন এক দুঃখের বিবরণ ছিল। গানের কথক বিরহের পথে বাতাসের মতো ঘুরপাক খেতে খেতে বহুদিন পর এসে ভিড়েছেন‌ প্রেমের উপকূলে। গাওয়ার সময় বিচ্ছেদের তীব্র অনুভূতিকে তিনি অনুবাদ করে নিলেন প্রিয় বন্ধু হারানোর বেদনায়। 

গাম কি রাহোমে ভাটাকতেথে হাওয়াওকি তারহা

উনকি বাহোমে সিমাটকার হামে আরাম মিলা

উনকি নাজরো সে মোহাব্বাত কা জো প্যায়গাম মিলা

গ্রীষ্মের ভয়ঙ্কর  সেই রাতটা এক বিন্দু অস্পষ্ট হয় নাই কখনও। বরং তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে প্রিয় পোষা প্রাণীর নির্মম মৃত্যুর স্মৃতি তিনি অবুঝ হৃদয়ে বয়ে চললেন বছরের পর বছর। যেকোনো দুঃখ যন্ত্রণার সুর সামনে আসলেই তিনি তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবন থেকে কুড়িয়ে আনেন একমাত্র পোড়া স্মৃতির ধুল। 

পনেরো বছর বয়সে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো আমাদের প্রিয় শিল্পীর জীবনে। মধ‌্য কৈশোরে এসে তিনি এমন এক শিক্ষকের দেখা পেলেন, যিনি অনায়াসে শেখালেন কী করে নিজের জগতের দেয়াল পেরিয়ে ভাবতে হয়। বললেন একজন শিল্পীর কল্পনা শক্তি হওয়া উচিত আসমানের মতো সীমানাহীন। এই অন্য রকম লোকটার সাথে তাঁর দেখা হলো লাহোরেই। স্টুডিয়োর সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে কাকে যেন মুঘল দরবার আর তানসেনের গল্প শোনাচ্ছিলেন। দাবি করছিলেন সত্যিকারের সুর সাধকের সাথে প্রকৃতির এক রহস্যময় যোগাযোগ থাকে। তিনি ছোটবেলায় তানসেনের মতো মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামানোর স্বপ্ন দেখতেন বলেই হাসতে শুরু করলেন নবীন কিশোরের মতো।

আগার ম্যায় গাতা তো জরুর দিয়ে জ্বালাতা, জরুর পানি বারসাতা!

বলতে বলতেই সদলবলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমাদের সুরের রাজকন্যাও চললেন নিঃশব্দে তাঁদের অনুসরণ করে। ভেতরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। বিশ তিরিশ জন যন্ত্রশিল্পীকে শেষ বারের মতো নির্দেশনা দিয়ে সুরকার মহোদয় এবার শিল্পীর খোঁজ করলেন। 

মুঝে খুশ হু কে আপনে মুঝে গানে কে লিয়ে কাহা।

গায়িকা মৃদুস্বরে পরিচয় দিতেই তাঁর তেতাল্লিশ বছরের মুখে আবারো কিশোরসুলভ হাসি ফুটল। নিজের হাতে একটা চেয়ার টেনে এনে বসতে দিলেন পনেরো বছর বয়সী জনপ্রিয়তম কণ্ঠশিল্পীকে। গানের খাতায় রোমান অক্ষরে কথা তুলতে দেখে অবাক হয়ে বোধহয় খেই হারিয়ে ফেললেন। গান তুলে দেয়া ভুলে গিয়ে একটানা স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন তাঁর বোম্বে জীবনের। সমুদ্র পাড়ের ঐ শহরে জীবন আর কাজের রঙ একেবারেই ভিন্ন ছিল। মাঝে মাঝে ভাবেন একবার ঘুরে আসবেন পুরোনো কর্মক্ষেত্র থেকে, কিন্তু এতো ব্যস্ততায় আর হয়ে ওঠে না । তাঁর শিষ্যরা নাকি আজকাল মোহনীয় সব সুর দিয়ে অগণিত মানুষকে মুগ্ধ করে রাখছে। 

ভদ্রলোক কথা বলেন সোজা বুকের গভীর থেকে। আমাদের গানের রানি প্রথম আলাপেই তাঁর ভীষণ ভক্ত হয়ে গেলেন। সঙ্গীতায়োজন যতখানি কানে এলো শুনে বুঝতে পারলেন বাকি সবার চেয়ে তাঁর কণ্ঠের কাছে এই সুরকারের প্রত্যাশা হবে আলাদা। একটু নার্ভাস লাগতে শুরু করলো।  সুরকার সাহেব যখন গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলেন, সুরের বিস্তার আর কারুকাজ শুনে তো শিল্পী বলেই দিলেন তাঁর পক্ষে এই পরিমাণ বিস্তৃত সুর গাওয়া অসম্ভব।

মা, ইটজ লাইক প্ল্যানিং আ ট্রিপ টু দ্য মুন।

মাকে  অনুরোধ করলেন সুরকারকে গিয়ে “না” বলার জন্যে। মায়ের মনে আবার কোনো এক অজানা কারণে সব সময় সাহস অনেক বেশি। সব শোনার পরও, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ফ্লাস্ক খুলে চা ঢেলে কিশোরী কন্যার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাথায় হাত রাখলেন‌।

দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলাম। চা শেষ করে মাইকের সামনে যাও, ঠিক গলা খুলে যাবে।

আত্মবিশ্বাসী মা আর দৃঢ়চেতা সুরস্রষ্টা তাঁকে এক রকম জোর করেই ঠেলে পাঠালেন মাইক্রোফোনের দিকে। বাধ্য সন্তানের মতো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তিনি অগত্যা চোখ ডুবালেন গানের খাতায়।

সাঁঝ কি লালি সুলাগ সুলাগ কার

বান গায়ি কালি ধুল

আয়ে না বালাম বেদারদি 

ম্যায় চুনতি রেহ গায়ি ফুল

ন্যায়না তারাস কার রেহ গায়ে

পিয়া আয়ে না সারি রাত

জীবনে প্রথম তিনি নিজের দুঃখ ভুলে কল্পনা করে নিলেন সমুদ্র পাড়ে দাঁড়ানো মলিন শাড়ি পড়া এক বিরহী মেয়ের মুখ। তাঁর নির্ঘুম চোখ থেকে তুলে আনলেন কষ্ট-কাতর অলঙ্কার। নিজেকে ভুলে গাইছেন আর তাঁর সীমানাহীন কল্পনা জুড়ে আছড়ে পড়ছে বিষাদ সিন্ধুর ঢেউ। শেষ লাইনে পৌঁছানোর আগেই এক মর্মবিদারী অনুভূতি তাঁকে ছেয়ে ফেলল। তিনি আবিষ্কার করলেন অন্যের আনন্দ বেদনার খাঁটি নির্যাস স্বকণ্ঠে ধারণ করার বিরল এক কৌশল। আমাদের গানের রানি চলচ্চিত্রের গানকেও আজ থেকে নতুনভাবে জানলেন। নিজেকে এখানে ছড়িয়ে দিতে হয় আত্মহারা আলোর মতো। নিজ অপরের ব্যবধান দূর করতে হয় মনের দুয়ার খুলে রেখে, কল্প‌-কবিতার আশ্রয়ে।

চলবে…
 

Comments

    Please login to post comment. Login