পোস্টস

গল্প

দেশান্তর

২৭ মে ২০২৪

তাসলিহা মওলা

রাত বিরেতে প্রকৃতির ডাক বড় বিরক্তিকর। জনার্দন ঘোষালের আবার মধুমেহ রোগ। রাতে তার বার তিনেক যেতেই হয় ঘরের বাইরে। আজো এই মাঝরাতে তার ভীষণ চাপ এসে গেছে। একে শীতের রাত, তার ওপর বুড়ো হাড়ে ঠকঠকি। বড় কষ্টে লেপের ওম ছেড়ে বেরোয় জনার্দন। হুড়কো খুলে ছোটে মোরগের খোপের পাশের ঝোপের দিকে। অত রাতে কে যাবে বদনা হাতে সেই দুই মাইল দূরের পায়খানায়? বুড়ো হাড়ে মটমট আও্যাজ তুলে বসে পড়ে হালকা হতে। কিন্তু হালকা হবার সুখ তার বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। সামনে দৃষ্টি আটকে যায়। একি! ভুত নাকি? সামনে এক ছায়ামূর্তির নড়াচড়া। একে পৌষের হিম ঝরা রাত , তায় অমাবস্যা। পেচ্ছাপ করা তার মাথায় ওঠে। পারে তো ওয়ি অবস্থায়ি উঠে পালায় জনার্দন। খিস্তি করে ওঠে বুড়ো, “ মর জ্বালা, আজ শেষও হতিছিনা, আইজকে ভুতের হাতেই মরণ আছে মোর। রাম নাম জপবার অবস্থায়ও নেই”। পরবর্তী ত্রিশ সেকেন্ড জনার্দনের জীবনের দীর্ঘতম সময় বলে তার মনে হয়। চোখ সেই ছায়ামূর্তির দিকে স্থির রেখে রামনাম জপতে জপতেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। চেষ্টা করে নিঃশব্দে ঘরের দিকে যেতে। কিন্তু বিধিবাম, শুকনো ডালের ওপর পা পড়ে মট করে আওয়াজ হয়। জনার্দনের মনে হয় এর চাইতে বোমা ফাটার আওয়াজও বুঝি কম হত। আঁতকে ওঠে সে। আঁতকে ওঠে সামনের ছায়ামুর্তিও। অস্ফুট এক নারী কন্ঠ কানে আসে। কানে আসে অন্য একটা ফিসিফিসে কন্ঠও – “চুপ চুপ, কথা কসনি”। এবার বুঝি কিছুটা সাহস পায় বুড়ো। ভুত হলে তো আর তাকে ভয় পেতনা। আর এযে দেখি দু’জন। গলা তুলে হাঁক পেড়ে ওঠে “ এই কে? কে রে ওইখেনে? কে কথা কয় এত রাতে? কে এত রাতে ওই খেনে”? তার গলা শুনে পালাতে যায় দুই ছায়ামূর্তি। কোথা থেকে কী শক্তি ভর করে জনার্দন বুড়োর দেহে কে জানে। ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে দুজনের একজনকে জাপটে ধরে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করতে থাকে, “ চোর, চোর, চোর এইছে, চোর এইছে, কে কোন্ঠে আছিস জলদি আয়”। তার হাতের বাঁধনে আটকে পড়া নারী দেহ ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করছে। জনার্দন কি আর ছাড়ে? সংসারে আজ সে প্রায় অপাংক্তেয়। আজ একটা কাজের কাজ করেছে বটে। 

ওদিকে নিস্তব্ধ মাঝরাতে তার হৈ হট্টগোলে জেগে ওঠে বাড়ির লোক। জেগে ওঠে আশেপাশের বাড়ির মানুষও। ছুটে আসে সকলে। ঠিক এমন সময় জনার্দনের কানে যায় “দাদু, আমি দীপু, আমি দীপু”। চমকে ওঠে জনার্দন। এতক্ষণের উত্তেজনায় কানে যায়নি কথাগুলো। ওদিকে আলো হাতে এগিয়ে এসেছে বাড়ির লোক আর আশে পাশের মানুষজন। হাতের বাঁধন শিথিল করে নাতনিকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে “দীপু? তুই কি কত্তিছিস এত রেইতে একেনে”? এগিয়ে আসে জনার্দনের বড় ছেলে হারাধন, দীপাবলির বাবা, এগিয়ে আসে তার সুরমা রাণীও। হাতে ধরা টর্চের আলো পড়ে দীপাবলির মুখে। ঘেমেনেয়ে মেয় একসা এ শীতের রাতে। কিন্তু ওকি? দীপাবলির পাশে ও কে?  তিন ব্যাটারির টর্চের আলোয় সে রাতে সকলে দেখে জনার্দন ঘোষালের নাতনীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ পাড়ার করিম শেখের বড় ছেলে জায়েদ শেখ। 

বাড়ির লোক তো বটেই, আশপাশের দু’ তিন কি চার পাঁচ বাড়ির মানুষেরও আর বোঝার বাকি রইলনা কিছুই। আচ্ছা!। জনার্দনের কলেজ পড়ূয়া মেধাবী নাতনীর তাহলে তলে তলে এই কীর্তি? তাও আবার মুসলমানের সাথে? ছি ছি ছি। মন্দ কথা কি আর চাপা থাকে? পৌষের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তখন আমতলি গ্রামে সেকি সরগোল। কি হয়েছে? আরে শোননি? জনার্দন ঘোষালের বড় নাতনি ধরা পড়েছে জনার্দনেরই হাতে, রাতে বিরেতে করিম শেখের ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টী করবার সময়। আর কেমন হাঁদারাম ছেলেরে বাবা, বুড়োতো ধরেছিল নাতনীকে, তুই হাবার মত দাঁড়িয়ে রইলি? 

এত গরম খবর শীতের রাতে যেন গ্রীষ্মের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল আমতলির বাড়িগুলোতে। সেই শেষ রাতেই সকলে ছুটল দক্ষিণ পাড়ায়, করিম শেখকে জানাতে তার ছেলের কীর্তি। ওদিকে দীপাবলিকে তার মা আটকে রেখেছে ঘরে। জায়েদকে দুইদিকে দুইজন ধরে নিয়ে হাঁটা ধরেছে দক্ষিণ পাড়ায়। ঘটনার আকষ্মিকতায় জনার্দন থতমত খেয়ে গেছে। কী হতে কী হয়ে গেল! উঠল পেসাব করতে , আর ঘটল কী! তাও আবার তার আদরের নাতনী। কত স্বপ্ন এই নাতনীকে নিয়ে তার। পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে জনার্দন, হারাধন আর হারাধনের ছোট ভাই সুধন। কারো মুখে কোন কথা নেই। থাকবে কিভাবে? সামনে কী দিন আসছে সে তো তারা বুঝতেই পারছে বাপ বেটা। 

দক্ষিণ পাড়া আর কতদুর? পৌঁছে যায় সকলে করিম শেখের বাড়ি। একেবারে হাঁকেডাকে, শোরগোলে জাগিয়ে দেয় করিমশেখের বাড়ির সকলকে। ঘুম চোখ ডলে অবাক হয়ে করিম শেখ দেখে তার ছেলে জায়েদকে ধরে রেখেছে উত্তর পাড়ার, মানে হিন্দু পাড়ার ভুবন দাস আর বিজন মন্ডল। 

“কিরে ভুবন, বিজন জায়েদরে ওভাবে ধরিছিস কেন? কি হইছে? কিগো জনার্দন কাকা, এত রেইতে তোমরা সক্কলে আমার বাড়ি কি কত্তিছ”?

জনার্দন আর কি বলবে? কিইবা বলবে হারাধন আর সুধন? যা বলার বলে দেয় ভুবন, বিজন, অসীম মিস্ত্রী, পরিতোষ ঘোষাল আরো সকলে। ছেলের কীর্তি শুনে সদ্য ঘুম ভঙা করিম শেখের মাথা হেঁট হয়ে যায়। এই হট্টগোলে পাশে বাড়ির মোমিন মেম্বর চলে এসেছে, এসেছে পেছনের বাড়ির মাইনুদ্দিনও। কারোও আর জানতে বাকী রইলনা মুসলমান পাড়ার ছেলে জায়েদ শেখ কিনা প্রেম করছে হিন্দু পাড়ার মেয়ে দীপাবলি ঘোষালের সাথে? এর একটা বিহিত যেন সে রাতেই করতে হবে। এবার চেঁচামেচিতে উঠে এসেছে ইউনিয়িন চেয়ারম্যানের ডানহাত রাশেদ আলি ওরফে গাল কাটা রাশু। সে এসে গম্ভীর মুখে আবারো শোনে পুরো ঘটনা। উপস্থিত গ্রামবাসীকে সে আস্বস্ত করে যে, এ অনাচারের কথা সকালে তুলবে চেয়ারম্যান সাহেবের কানে। তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেবেন। রাশুর আস্বাসে সকলে ঘরের দিকে রওনা হয়। রওনা হয় জনার্দন আর তার দুই ছেলেও। রিক্ত, নিঃস তিনজন। ভেবে পাচ্ছেনা কাল সকাল কি বয়ে আনবে তাদের পরিবারের জন্যে। 

ভেবে পাচ্ছেনা জায়েদও। কপালের ফের বুঝিবা একেই বলে! কতদিনই তো মাঝরাতে দীপাবলির কাছে ছুটে গেছে সে কই এমনতো কক্ষনো হয়নি? আজই উঠতে হল জনার্দন দাদুর?  আল্লাহ কি চান না তবে তা্রা সুখী হোক?  সে দীপাবলিকে কথা দিয়েছে, কখনো ছেড়ে যাবেনা। তাইতো আজ ওকে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। মরার হলে একসাথেই মরবে। সে কবরে গেলে তার দীপও যাবে কবরে, দীপ চিতায় উঠলে সেও গিয়ে উঠবে চিতায়। এমনটাই তো কথা দিয়েছে তারা একে অপরকে। সামনে ভিড় করে থাকা মানুষজন চলে গেছে। উঠোনে দাঁড়ীয়ে আছে শুধু করিম শেখের পরিবার। 

ভোরের আগে রাতের আঁধার গাঢ় হয়। আজ রাত শেষের আঁধার যেন নিকষতম। করিম শেখের বৌ সাহারা বানুই প্রথম নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলে ওঠে, ছেলেকে ডাকে “জায়েদ, আর হিমে দাঁইড়ে থাকিসনি, চল ভেতরে চল বাপ আমার”। 

গর্জে ওঠে করিম শেখ “এহ! সোহাগ কইরে আবার বাপ ডাকা হচ্ছে? তোমার গুণধর ছেলের জন্যি এবার এ গিরামের পাট চুকোতি হবি, এই আমি কইয়ি দিচ্ছি বানু”।       

সাহারা বানুও কম যায় কিসে? মুখ ঝামটে স্বামীকে ধ্মকে ওঠে “কাল সকাল পর্যন্ত সময় আছে আপনের হাতে। আর কি এমন কইরেছে আমার ছাও্যাল যে গাঁ ছাইড়ে যেতি হবি, সালিশ বসাতি হবি”?

বুঝিবা এই অমাবস্যার রাতে চাঁদ উঠলেও এত অবাক হতনা, যতটা অবাক হয়েছে করিম শেখ বৌ এর কথায়। কি বলে জায়েদের মা? জায়েদ রাত দুপুরে হিন্দু পাড়ায় গিয়েছিল প্রেম করতে, আর তার মা বলছে সে কি করেছে এমন? নিজ স্ত্রী কেমন একরোখা, জেদী তা জানে করিম শেখ, তাই আর কথা না বাড়ীয়ে ঘরে চলে যায়। জায়েদকে নিয়ে ঘরে চলে যায় তার মা, পেছন পেছন বাড়ির বাকী সদস্যরাও ঢুকে যায় ভেতরে। ঘটনার আকস্মিকথায় সকলেই হতভম্ব হয়ে গেছে। 

ওদিকে জনার্দন শেখের বাড়ীতে দীপাবলির ওপড় চড়াও হয়েছে তার মা শোভা রাণি আর বাবা হারাধন। গুমুর গুমুর ঘা বসিয়ে দিচ্ছে পিঠে, চুল টেনে, গালে চড় মেরেও যেন শান্তি হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে বুঝি মেরে ফেললেই শান্তি পাবে তারা। মারের চোটে কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে দীপুর। তবু চোখ শুকনো যেন মরুভূমি – জল নেই একফোঁটা সেখানে। বিরামহীন মারের এক পর্যায়ে হারাধন আর শোভারাণীকে এসে থামায় সুধনের বৌ মালা। জায়ের হাত আঁকড়ে ধরে বলে “দিদি কি পাগল হইয়ে গেলে? মেইয়েটা তো মইরে যাবে গো দিদি”। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে দীপুর মা –“ মইরে যাক, এতদিন কেন বেঁচে ছিলি মুখপুড়ী। আমাদের যে সব শেষ হইয়ে গেল। কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটা লেকাপড়া কইর‍্যে , চাকরি কইর‍্যে দিন ফিরোবে, সব গেল রে মালা, সব নাশ হইয়ে গেল”। তার কান্না শুনে কেঁদে ওঠে হারাধন, জনার্দন, সুরমা, সুধন, মালা, সাথে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো। কেঁদে ওঠে উঠোনের কুকুর ভুলোও। বুঝিবা বুঝে গেছে তার মনিবদের আজ ভীষ্ন বিপদ। রাত প্রায় শেষ, ভোরের অপেক্ষায় জেগে থাকে ঘোষাল বাড়ির সকলে, সকলের চোখেই জল। শুধু জল নেই দীপাবলির চোখে। তার যা বোঝার, জানার তা সে জেনে গেছে। জায়েদ তাকে ছেড়ে যায়নি।  সে চাইলেই পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে কথা রেখেছে। কথা রেখেছে সে তার দীপের হাত কখনো ছাড়বেনা। 

অবশেষে সকাল আসে। সকাল আসে ভারত সীমান্তবর্তী আমতলি গ্রামে। সকাল আসে করিম শেখের বাড়িতে, সকাল আসে জনার্দন ঘোষালের বাড়িতেও। পুরো গ্রাম আজ উন্মুখ হইয়ে আছে সালিশের সিদ্ধান্ত জানতে। এখানে ওখানে জটলা। হিন্দু পাড়ায় যেমন সব ফিসিফাস, কানাঘুষো করছে, মুসলমান পাড়ায়ও। হবেনাই বা কেন? প্রতাপসালী করিম শেখের একমাত্র ছেলে জায়েদ শেখ বলে কথা। কি রায় চেয়ারম্যান সাহেব দেবেন তা শুনতে সকলের ঘুম হারাম হবার জোগাড়। 

বেলা দশটা নাগাদ সকলে এসে জড়ো হয়েছে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনের মাঠে। সকলেই উদগ্রীব কি সাব্যস্ত হয় সালিশে তা শোনবার জন্যে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবার চোখেমুখে চাপা এক উত্তেজনা। বহুদিন পর আমতলি গ্রামে সালিশ বসছে, তাও আবার মুসলমান হিন্দুর মাঝে প্রেম ঘটিত ব্যাপারস্যাপার। দুই প্রেমিকযুগল বিশেষ করে জনার্দনের নাতনীর শাস্তি দেখবার জন্য সবাই একেবারে প্রথম সারির আসন দখল করতে উঠেপড়ে লেগেছে।  

যথাসময়ে চেয়ারম্যান নুরুন্নবী হোসেন এসে পড়ল মাঠে। সাথে মোমিন মেম্বর, মসজিদের ইমাম ফকরুদ্দিন, কাজী সাহেব সালামত আলী সকলেই এসেছে। এসে পৌঁছেছে করিম শেখ সাথে তার দুই ভাই জসিম শেখ আর মতিন শেখ এবং অবশ্যই জায়েদ। জনার্দনও এসেছে হারাধন আর সুধনকে সাথে নিয়ে। দীপাবলিকে নিয়ে আসতে নিষেধ করেছে মাইনুদ্দিন। যা বিচার হবে তা তো জানাই যাবে। বেহুদা মেয়েটাকে আর বিব্রত করার কি দরকার? গ্রামের কচি ছেলেপুলে গুলোও বাদ যায়নি। 

সকলের উপস্থিতিতে শুরু হল সালিশ। প্রথমেই ঘটনার বর্ণনা দিল গালকাটা রাশু। যা ঘটেছে তার ওপরে রঙ চড়িয়ে, পলেস্তারা লাগিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে সবিস্তারে বলল, সকলে শুনল ততোধিক তাড়িয়ে তাড়িয়ে। সকলের দৃষ্টি সামনের সারিতে যেখানে চেয়ারম্যান, ইমাম ও কাজী সাহেব বসে। শুরুটা করল নুরন্নবী চেয়ারম্যানই। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল “আসলে বিষয়টা জটিল , তাই এর বিচারও জটিলই হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আমরা বরঞ্চ কাজী সাহেবের কাছ থেকে শুইনে নেই কি করা যায়”। কাজী সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে দোয়া দরুদ পড়ে, ইস্তিগিফার পড়ে শুরু করলেন তাঁর বয়ান। “কথা হতিছে, যা শুনলাম ও বুঝলাম, কাল রেইতের পুরো ঘটনাই হল সোজাসাপ্টা জীনা। পাত্রপাত্রী উভয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হইলেও অবিবাহিত, তাদের মাঝে কোন বৈবাহিক সম্পর্ক নেই। তার চাইতে বড় কথা হতিছে, দুজনের ধর্মও আলাদা। এইখেনে এসে শাস্তির বিধান নিয়ে কিছু সমস্যা আছে, ইমাম সাব কি বলেন”?

এতক্ষণ বসে বসে সব শুনছিলেন ইমাম ফকরুদ্দিন। এখন নড়েচড়ে বসলেন কথা বলার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে বলে শুরু করলেন “দেকেন, আমিও সব শুনলাম। ইসলামে জেনাকারীর জন্য নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান আছে। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে। কিন্তু সেটা যদি উভয়ে মুসলিম হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একজন দোষী হল গিয়ে হিন্দু। তাই শাস্তির বিধা্ন এমন করবার জো নেই। আমরা চেয়ারম্যান সাবের কাছ থেইকে শুইনব। তিনি যা সাব্যস্ত কইরবেন তাই মাইনে নেব সকলে”। 

মনে মনে ইমামকে কষে একটা গাল দেয় রাশু। খুব আশা ছিল জনার্দনের নাতনীকে বেতের বাড়ি মারবার দিল সব ভেস্তে। শালীর যে তেল হয়েছে। তাকে পাত্তাই দেয়না। আজ বোঝ প্রেমের মজা। এই জায়েদও কি কম হেনস্তা করেছে রাশুকে? আজ সুদে আসলে সব পুষিয়ে নেবে রাশু। 

ওদিকে চেয়ারম্যান কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। পানের পিক ফেলে, মুখ মুছে সে যা বলল তার সারমর্ম হল এই “ যেহেতু দোষকারী পাত্র পাত্রী একই ধর্মের নয়, সেহেতু ইসলামী বিধান মানাটা আমাদের জন্যি কঠিন হতিছে। তবে শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবি। এটা গুরুতর অন্যায়। তবে অবস্থা ভেদে শাস্তিও ভিন্ন হবি”।

উপস্থিত সকলের মাঝে গুঞ্জন ওঠে। সকলেই আগ্রহী বিচার জানবার জন্যে। 

চেয়ারম্যান তার রায় ঘোষণা করছে। 

“তা, এই সালিশী বিচার সভা প্রায় শেষের পথে। আমরা কাজী সাব আর ইমাম সাবের কথা শুনলাম। উভয়েই ঠিক কয়েছেন। তা, আমার মতে, সমাজের রীতিনীতি মাইনে তবে সিদ্ধান্তে আইসতে হইবে। দুই পরিবারের জন্যি আমার সিদ্ধান্ত দুই ধরণের হবি। করিম শেখের ছাও্যাল অন্যায় করিছে, রেইতের বেলা অন্যের বাড়ি যাইয়ে, অন্যের মাইয়ের সাথে খারাপ কাজ কইরেছে। তার জন্যি গ্রামের মাথা হেঁট হইয়েছে। শাস্তি হিসেবে করিম শেখ কে মসজিদ ফান্ডে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবি, আর জায়েদকে সবার সামনে করজোড়ে মাফ চাইতি হবি, এবং সেটা এখনই। জনার্দন কাকার পরিবারের জন্যি সিদ্ধান্ত এর পর আমি দেব। আগে জায়েদের বাপ কি বলে শুনি”। 

করিম শেখের এমনিই মাথা হেঁট হয়ে আছে। এ সিদ্ধান্ত না মেনে তার আর উপায় কি? সর্বসমক্ষে সে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রাজি হল বিনাবাক্যব্যায়ে। জায়েদকেও বলল ক্ষমা চাইতে। সরল মনে জায়েদ সকলের কাছে ক্ষমাও চাইল করজোড়ে। সে কৃতজ্ঞ গ্রামের মাথাদের কাছে যে অন্তত দীপাবলিকে দোররা মারার সিদ্ধান্ত কেউ দেয়নি। শাস্তিই বা এমন কি হবে। জরিমানা, অথবা কয়েকদিন দীপাবলি বেরোতে পারবেনা। 

কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙল। চেয়ারম্যান তার সিদ্ধান্তে বলে চলেছে “ জনার্দন কাকার নাতনী মাইয়ে মানুষ হইয়ে, রাত গভীরে জায়েদের সংগে মেলামেশা কইরে ঘোরতর অন্যায় কইরেছে। হিন্দুর ঘরের মেয়ে হইয়ে মুসলমানের ছেলের সাথে প্রেম করবার সাহস করা তার মোটেও উচিত হয়নি। আর তার পরিবারেরও এতে দোষ আছে। মেয়েকে তারা সেই শিক্ষাই দেয়নি। তাই কাজী সাব আর ইমাম সাবের সাথে পরামর্শ কইরে আমি এই সিদ্ধান্তে আসলাম যে, আজ থেইকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জনার্দন ঘোষাল ও তার পরিবারকে এক ঘরে করা হইল। কেউ তাদের কাছে যাবেনা, দোকানীরাও তাদের কাছে কিছু বেইচবেনা”। 

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল জনার্দন আর তার দুই ছেলের। পায়ের মাটি সরে গেল জায়েদের। সে প্রতিবাদ করে উঠল। “এ কেমন কথা চেয়ারম্যান কাকা? দোষ আমরা দুজনেই করেছি, শাস্তির এত রকমফের কেন”? করিম শেখ আর তার ভাইয়েরা থামিয়ে দেয় জায়েদকে জোর করে, টেনে নিয়ে যায় বাড়ী। 

মনে মনে খুব খুশী হয় রাশু। সকালে দোররা মারার বুদ্ধির সাথে সাথে, এই একঘরের বুদ্ধিও সে দিয়েছিল চেয়ারম্যানকে। সাড়ে ছয় বিঘা জায়গার ওপর জনার্দনের বাড়ীর। একঘরে হয়ে কয়দিন আর থাকবে তারা? পাড়ি জমাবে ইণ্ডিয়া। তখন জমি হবে চেয়ারম্যানের। তবে পাঁচ বিঘা জমি চেয়ারম্যান নিজে রেখে দেড় বিঘা দেবে রাশুকে, এমনটাই কথা হয়েছে তার সাথে। 

সালিশ ভেঙে দিয়ে এগিয়ে যায় চেয়ারম্যান। সকলে যে যার বাড়ি চলে যায়। বাড়ি চলে যায় জনার্দনও। কান্নার রোল পড়ে বাড়িতে। সকলেরই মনে অজানা আতঙ্ক, তারা আসলে কিভাবে বাঁচবে, শেষমেশ সাত পুরুষের এই ভিটে ছেড়ে না চলে যেতে হয়?

প্রথম দিনকয়েক নির্বিঘ্নেই কেটে গেল। সপ্তাহ ঘুরে যাবার পর এলো বিপত্তি। বাড়িতে চাল, ডাল, আলু আর বাগানের সবজি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সেগুলোও তো একসময় শেষ হয়ে যাবে। গাভীদুটোকে দেবার মত ভুষিও নেই। কোনমতে শুকনো ঘাস আর খড় খাইয়ে রেখেছে। খেতে পাচ্ছেনা সেভাবে, তাই দুধও দিচ্ছে কম। এভাবে কতদিন তারা চলবে ভেবে পাচ্ছেনা। জনার্দন বুড়ো বসে বসে নিজের কপাল নিজে চাপড়ায় আর ভাবে, নিজ হাতে মেয়েটার জীবন তো নষ্ট করলামই, পুরো পরিবারকে ঠেলে দিলাম বিপদের মুখে। একটু ধৈর্য ধরলে কি আর এমন হত?

ওদিকে দীপাবলি সেই যে চুপ হয়ে গেছে সে রাতের পর থেকে, আর কথাটী বলেনি তেমন। খেতে দিলে খায়, নইলে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে থাকে। ভালবাসার এ কেমন শাস্তি তা সে ভেবে পায়না। নিজ পরিবারকে এভাবে বিপদের মুখে তো প্রকারান্তরে সেই ঠেলে দিল। এমনই একদিন, জনার্দন আসে নাতনীর ঘরে। তখন শুয়েছিল দীপাবলি। নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ দিদি ভাই, আমায় ক্ষমা কইরে দিস। সেদিন যদি তোর কথা শুনতাম আজ আর এই দিন আইসতনা”। দাদুর কথায় কি ছিল কে জানে, এতদিনের কঠিন পাথর রূপ ভেঙে যায় তার। দাদুকে জড়ীয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে সে। ছুটে আসে বাড়ীর সকলে। কাঁদে তারাও। তার কিছুটা দীপুর কান্না শুনে আর বেশীরভাগটাই আসন্ন বিপদের কথা ভেবে। এ দশদিনে সবাই বুঝে গেছে, এক ঘরে হয়ে বেশিদিন তারা আমতলিতে টিঁকে থাকতে পারবেনা। 

এরইমাঝে একদিন রাতে ঘোষাল বাড়ির টিনের চালে কে বা কারা ঢিল মারতে থাকে। মুহুর্মুহু ঢিলের শব্দে সেরাতে আর কেউ ঘুমাতেই পারলনা। এভাবে কেটে গেল পনের দিন। খারাব কমে আসছে দ্রুত। বাচ্চার ঘরে আর কত হিসেব করে চলা যায়? এর মাঝে একদিন বিমলের বৌ লুকিয়ে কিছু চিড়া, নাড়ু দিতে এসেছিল। দেখে ফেলেছিল রাশু। এসে শাঁসিয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলতে দেখলে আরো কঠোর হয়ে যাবে শাস্তি। জনার্দনের পরিবার ভেবে পায়না আর কত কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে? 

একদিন লুকিয়ে বাড়ী আসে পাশের বাড়ির জীবন মিস্ত্রী। আদোপান্ত শুনে একটা কথাই বলে, চলে যাও জনার্দন কাকা। এরপর আর মানসম্মানও রাখবেনে চেয়ারম্যান। আজকাল একদিন অন্তর ঘরের চালে ঢিল পড়ছে। এ যেন এক রুটিন হয়ে গেছে।  সকলেই সব জানে, কিন্তু টুঁ শব্দটি কেউ করেন।  একদিন এলো রাশু। এসেই প্রস্তাব দিল দীপাবলিকে যদি চেয়ারম্যানের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে, তবেই এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে নুরন্নবী চেয়ারম্যান। সেদিন আর সামলাতে পারেনা হারাধন। সে বলে দেয় রাশুকে “ দেখ রাশু, বড় বাড় বাইড়েছে তোর। আমার একরত্তি মেয়েটারে আমি কিনা ওয়ি বুড়ো ভামের সাথে বিয়ে দেব, তাও দোজবরে? তুই যা। আর কোনদিন এমন কথা কইতে আসবিনে”।  সে রাতে আবার আসে বিজন সাথে তার বৌ। সকালে রাশুর কথাবার্তা ওরা শুনেছে, শুনেছে হারাধনের কথাও। আর ওদিকে দক্ষিণ পাড়ায় চেয়ারম্যানের বাড়ি আজ আমিন এসেছিল। মনে কু গাইছে বিজনের। বছর দশেক আগে, ্রমেশ দাশের কথা মনে পড়ে যায়। ভিটেবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল রাতে। কোনমতে জান নিয়ে বর্ডার পার হয়েছিল তারা। সে এও জানে যে, জনার্দন কাকা তার পরিবার নিয়ে চলে গেলে এই ভিটে, এই জমি সবই যাবে চেয়ারম্যানের পেটে। কিন্তু রাতে যদি আগুন জ্বালিয়ে দেয়? জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে পুরো পরিবারকে? যেভাবে দিনের পর দিন ঢিল মেরে যাচ্ছে, আর আজ যা বলে গেল বদমাশ রাশু, তা তো ভয়ংকর বিপদের আভাসই দিচ্ছে। এভাবে আর কতদিনইবা তারা চলবে? রাতবিরেতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেও্যাও তাদের বন্ধ। সন্ধ্যে হতে না হতেই আতঙ্কে দুয়ার দিয়ে সকলে বসে থাকে ঘরে। এ দুর্বিসহ জীবন আর সহ্য হচ্ছেন কারো। আজ তাই বিজন যখন আবার পরামর্শ দেয় ইন্ডিয়া চলে যাবার, হারাধন রাজী হয়ে যায় একবাক্যে। আগে তার পরিবারের সকলের জীবন। এখানে থাকলে এমনিতেও তারা না খেয়েই মরবে। তার চাইতে বর্ডার পার হয়ে ওপারে গিয়ে বরঞ্চ ভিক্ষে করে খাবে, সেও ঢের সম্মানে মনে হয় তার কাছে। 

প্রথমেই আপত্তি করে তার বাবা জনার্দন। বলে “তোরা চইলে যা বাপ, আমি আর তোর মা এইখেনেই থাকি। কদ্দিন আর বাঁচব বল? সাত পুরুষের ভিটে, মোর জন্মভূমি। শেষ বয়সে আর ঠাঁই নাড়া হতি মন টানেনারে বাপ”। হারাধনের সাথে এবার সুধনও জোর আপত্তি তোলে। এই সাত পুরুষের ভিটে আগুন দেবে চেয়ারম্যান যে কোন দিন। শেষমেশ কি তার বাপ মা আগুনে পুড়ে কয়লা হবে? তবু জনার্দনের মন সায় দেয়না, তবু সে আমতলির মায়া ছাড়তে পারেনা। কিন্তু বেঁকে বসে তার বৌ সুরমা রানী। জানিয়ে দেয়, ছেলে মেয়ে নাতি নাতকুর ছেড়ে সে থাকবেনা। চলে যাবে সে ইন্ডিয়া। এত অপমান, অসম্মান আর আতঙ্ক নিয়ে এ গাঁয়ে আর না। অগত্যা আর গোঁয়ার্তুমি করেনা জনার্দন। চোখের জলে ভেসে রাজী হয়ে যায়। 

হারাধন বিজনের সাথে পরামর্শ করে যাবার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে। আর একটা ঘোর অমাবস্যার রাতে তারা সকলে বেরিয়ে আসে বাড়ী থেকে। হাতে যৎসামান্য বাক্স প্যাঁটড়া। শেষবার ফিরে তাকায় আশৈশব বেড়ে ওঠা বাড়িটির দিকে। তালা লাগায় দরজায়। যদিও জানে, এ তালা কাল সকালেই খোলা হবে। ঘোষালদের সাতপুরুষের ভিটের মালিক হবে চেয়ারম্যান নুরন্নবী আর গালকাটা রাশু। 

বিজন বর্ডারে সব ঠিক করে রেখেছে। তার লোক পার করে দেবে ঘোষালদের। সামনে হারাধন, বিজন আর বিজনের ছেলে অপূর্ব। পেছনে জনার্দন ঘোষালের পুরো পরিবার। চোখের জলে ভেসে, সাজানো সংসার, মাতৃভূমি ছেড়ে তারা পাড়ি জমায় অজানার পথে। সবার পেছনে দীপাবলি। তার মন চাইছে এখানেই মরে যেতে। আজ তার কারণে পুরো পরিবার দেশ ছাড়া হচ্ছে। অন্ধকারে, তারার আলোয় নিঃশব্দে পথ চলে তারা। বর্ডার প্রায় এসে গেছে। বিজনকে জড়িয়ে ধরে হারাধন। কেঁদে ফেলে উভয়েই। এ জীবনে আর হয়ত দেখা হবেনা ওদের। হঠাত এক ছায়ামূর্তির এগিয়ে আসা টের পায় সকলে। ভয়ে কাঁটা হয়ে যায় প্রতিটি মানুষ। এগিয়ে আসে ছায়া মূর্তিটি। কাছে আসতেই সকলে অবাক হয়ে দেখে, আর কেউ নয়, করিম শেখের ছেলে জায়েদ শেখ। জনার্দনই জিজ্ঞেস করে “জায়েদ, তুই এইখেনে? কি চাস আবার”? জায়েদ কাছে গিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলে, “আমিও যাব দাদু। আমি তোমার নাতনিরে কথা দিয়েছি, ওরে ছাইড়ে কোথাও যাবনি” । সকলে হতবাক শুধু বিজনের ছেলে অপূর্ব ছাড়া। সেই তো খবর দিয়েছে বন্ধুকে। এবার হারাধন এগিয়ে আসে। বলে, “ বাড়ি যা জায়েদ, পাগলামো করিসনি”। জায়েদ নাছোড়বান্দা। জলভরা চোখে দীপাবলি তাকিয়ে আছে জায়েদের দিকে। এভাবে কথা রাখবে জায়েদ? সব ছেড়ে চলে যাবে তার সাথে? জায়েদের দিকে এগিয়ে যায় জনার্দন। বলে “দাদুভাই, আমরা হিন্দু। যেইখেনে যাচ্ছি সেও হিন্দুর দেশ। তুই মুসলমানের ছেলে, কি পরিচয়ে সেই দেশে গিয়ে থাকবিরে দাদুভাই”? 

দীপাবলির দিকে এগিয়ে যায় জায়েদ। তার হাত ধরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে বলে “ মানুষ পরিচয়ে”।