Posts

গল্প

দালাল

July 18, 2025

Fijon Qurayish

Original Author ফিজন কোরাইশ

93
View

কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। ধুলোবালির পথ, চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, আর তার মাঝে একটি খড়ের ছাউনির ঘর—সেখানে বাস করে জাহিদ নামে এক গরিব কৃষক ও তার ছেলে হায়দার।

হায়দারের চোখে স্বপ্ন—একদিন বিদেশ যাবে, বাবার সব কষ্টের অবসান ঘটাবে।
জাহিদ ছেলের সেই স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে। জমি বিক্রি করে, ধার-করজ করে ঢাকায় পাঠায় হায়দারকে।

ঢাকায় এসে হায়দার মামার বাসায় ওঠে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে খোঁজে চাকরি। কিন্তু ঢাকায় চাকরি পাওয়া সহজ না।

একদিন গাবতলীতে গিয়ে এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়। লোকটার পরনে পাঞ্জাবি, মুখে মোটা গোঁফ, গলায় ভারী গলার আওয়াজ—

“ভাই, আপনার মতো ভালো ছেলেকে তো দেশেই রাখলে হবে না। আমি বিদেশে পাঠাই—দুবাই, মালয়েশিয়া, কাতার—আপনি শুধু টাকা দিন, বাকিটা আমি ম্যানেজ করবো।”

লোকটার নাম শামীম।
সে বলে, “আমি কোনো দালাল না ভাই, আমি কনসালটেন্ট। আমি সরকার অনুমোদিত কোম্পানির জন্য লোক পাঠাই।”

হায়দার মুগ্ধ হয়।
দেখে তো মানুষটা ভদ্র, কথাবার্তাও খুব গুছানো।
শামীম তার অফিসে নিয়ে যায়—"Golden Future Consultancy"। স্যুট-টাই পরা ২-৩ জন কর্মচারী বসে আছে। দেয়ালে অনেক ভিসার কপি, বিদেশি কোম্পানির লোগো, কিছু ছবিও টাঙানো—যেমন একজন মালয়েশিয়ায় রেস্টুরেন্টে কাজ করছে, কেউ দুবাইয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।

সবকিছু দেখে হায়দার বিশ্বাস করে ফেলে।

বাবার জমি বিক্রি করে পাওয়া শেষ ২ লাখ টাকা তুলে দেয় শামীমকে।
শর্ত একটাই—এক মাসের মধ্যে ভিসা আর টিকিট, নতুবা টাকা ফেরত।

এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ… এক মাস পেরিয়ে যায়…
শামীম বলে, “দুবাইতে নতুন কোটার জন্য একটু সময় লাগতেছে ভাই, চিন্তা কইরেন না।”

আরও ১৫ দিন…
হায়দার অফিসে গেলে বলে,

“স্যার বাইরে গেছেন… আজ আসবেন না।”

ফোনে কল দিলে বাজে, কিন্তু কেউ ধরে না।

তখনই হায়দারের বুকের ভেতর কেমন জানি করে ওঠে।

সেদিন সন্ধ্যায় আবার যায় অফিসে—দেখে দরজা বন্ধ, তালা ঝুলছে। পাশের দোকানের দারোয়ান বলে, “ভাই কয়েকদিন হলো কেউ আসে না।”

হায়দার বুঝতে পারে সে ধরা খেয়েছে। তার জীবন, তার বাবার স্বপ্ন, সব শেষ হয়ে গেছে।

তবে এখানেই থেমে যায় না সে।
সে খুঁজে খুঁজে জানতে পারে—শুধু সে না, এমনভাবে অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে প্রতারণা করেছে শামীম। কেউ ৩ লাখ, কেউ ৫ লাখ দিয়েছে। কেউ কেউ বিদেশেও গেছে, কিন্তু পাচার হয়ে গিয়ে গার্মেন্টসে বন্দী অবস্থায় কাজ করছে।

এ যেন এক ভয়ংকর চক্র।

হায়দার এবার আর চুপ থাকে না।
সে ছদ্মবেশে আবার শামীমের অফিসে যায়—এইবার ক্লায়েন্ট সাজে। গায়ে সাধারণ জামা, হাতে পুরোনো একটা ব্যাগ, মুখে লোভী ছেলের অভিনয়।

শামীম তখনো নতুন শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে।
হায়দারকে দেখে খুশি হয়ে বলে,

“ভাই, আজকাল তো সবাই আমার নাম জানে। আমি কথা দিলে পাঠায় দেই। দুই লাখ টাকা লাগবে, ১ মাসেই মালয়েশিয়া।”

হায়দারের ফোনে তখন গোপনে রেকর্ড হচ্ছে সব কথা।

পরদিন হায়দার এসব ভিডিও, অডিও, রসিদ নিয়ে যায় একজন সাংবাদিক বন্ধুর কাছে।
প্রথমে কেউ নিতে চায় না, ভয় পায়। কারণ শামীমের নাকি রাজনৈতিক পরিচয় আছে। সে নাকি এক এমপির লোক।

কিন্তু এক সাহসী অনলাইন পত্রিকা “বাংলা অনুসন্ধান” পুরো গল্পটি নেয়।

তারা বানায় একটি ভিডিও রিপোর্ট—
“স্বপ্নের সওদাগর: দালালের রাজত্ব”

প্রকাশ হতেই চারদিক তোলপাড়।
ফেসবুক, ইউটিউব, নিউজ—সবখানে শামীমের ছবি ভাইরাল।

লোকজন চেনে,

“এই লোক আমার ভাইয়ের টাকা খেয়েছে!”

“আমার বাবা জমি বিক্রি করে এই শয়তানকে দিয়েছিলেন!”

শামীম গা ঢাকা দেয়।
অফিস বন্ধ, ফোন বন্ধ, কেউ জানে না সে কোথায়।

কিন্তু হায়দার থেমে যায় না।

সে জানে, শামীম শুধু একজন দালাল নয়—সে একটি চক্রের অংশ।
তার পেছনে আছে বড় বড় নেতা, পুলিশ, এমনকি বিদেশি কোম্পানির নাম করে ভুয়া দালাল সিন্ডিকেট।

হায়দার এবার ঠিক করে—
এই চক্রের শেকড়ে আঘাত করবে…

শেষ অংশ: শিকড় উপড়ে ফেলা

ঢাকার নিচে যেন আরেকটা ঢাকা আছে—
সেখানে স্বপ্ন কেনাবেচা হয়, আর মানুষ দাসে পরিণত হয়।
হায়দার এই অদৃশ্য জগৎটাকে ভাঙতে চায়।

শামীম গা ঢাকা দিলেও হায়দার তাকে খুঁজে পেতে থাকে।
সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারে—সে এখন গাজীপুরে এক “নতুন নামের” অফিস খুলেছে, “Asian Work Solutions”।

নাম বদলেছে, মুখ বদলায়নি।

 হায়দার এবার এক নতুন দল তৈরি করে—

৩ জন ভুক্তভোগী

১ জন সাংবাদিক

১ জন আইনজীবী

আর নিজে

তারা পরিকল্পনা করে একটা ফাঁদ
এক তরুণকে ক্লায়েন্ট সাজিয়ে পাঠানো হয় নতুন অফিসে।
ভিডিও রেকর্ড হয়, টাকা চাওয়া হয়, ভুয়া ডকুমেন্টও দেখানো হয়।

সব প্রমাণ হাতে নিয়ে হায়দার এবার সরাসরি র‍্যাব অফিসে যায়।

প্রথমে অফিসাররা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না,
তবে সাংবাদিকের রিপোর্ট আর ভিডিও দেখে এক কর্নেল সাহস দেখান।
তিনি বলেন,

“এই চক্রকে ধ্বংস করতেই হবে। এর সঙ্গে যারা জড়িত, কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।”

 একদিন সকাল বেলা
একটি বড় অভিযানে র‍্যাব হানা দেয় গাজীপুর অফিসে।
শামীমসহ ৩ জন গ্রেফতার হয়।
অফিস থেকে উদ্ধার হয়—

২০০+ পাসপোর্ট

৭ লাখ নগদ টাকা

৫ টি জাল কোম্পানির সিল

এবং বহু মানুষের আবেদনপত্র

 নিউজে ব্রেকিং হয়ে যায়:
"বাংলাদেশে দালাল চক্রের বড় নেতা গ্রেফতার"

 কিন্তু হায়দার জানতো, এটা কেবল শুরু।

শামীম পুলিশ হেফাজতে গেলেও কয়েকদিন পর জামিন পায়।
তখনই হায়দার বুঝে যায়—এই চক্র অনেক গভীর।

একদিন রাত ১০টার দিকে তার বাসায় হুমকি ফোন আসে,

“তুই থাম না হলে তোর বাবার খবর আছে।”

সেই রাতে সে বাবা-মাকে ফোন করে বলে,
“বাবা, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি যদি আজ মরে যাই, তবু এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবো।”

 হায়দার এবার শুরু করে এক প্রচার অভিযান—

ফেসবুকে লাইভে আসে, ভিডিও পোস্ট করে,
ভুক্তভোগীদের নিয়ে “দালাল মুক্ত বাংলাদেশ” নামে এক ক্যাম্পেইন চালায়।

হাজারো মানুষ জড়ো হয় তার পাশে।

 হায়দার পরে এক ব্যারিস্টারের সহায়তায় হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করে।
মামলার মূল দাবি—

“দালাল চক্রকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

এই মামলা জাতীয় সংবাদপত্রে আসে।
সরকার বাধ্য হয় পদক্ষেপ নিতে।

 একদিন, হায়দারকে ডাকা হয় সংসদীয় কমিটির বৈঠকে।
তাকে বলা হয়, “তুমি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছো।”

এক বছরের মাথায়
দেশে ৫৭টি ভুয়া বিদেশ পাঠানো কোম্পানি বন্ধ হয়।
শামীম আবার গ্রেফতার হয়, এবার রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও তদন্ত শুরু হয়।

 শেষ দৃশ্য:

হায়দার এক স্কুলে গিয়ে বক্তৃতা দেয়—

“স্বপ্ন দেখো, কিন্তু দালালের দরজায় নয়।
স্বপ্ন গড়ে তোলো নিজে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও।”

তাকে চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে শত শত কিশোর—
যাদের চোখে এখন শুধু স্বপ্ন নয়, সাহসও জ্বলছে।

 শেষ

“দালাল” গল্পটি এখানেই শেষ।
এটা শুধু একটি গল্প নয়, এটা আমাদের সমাজের বাস্তবতা।
যেখানে হাজারো হায়দার এখনও প্রতিদিন শিকার হচ্ছে।
কিন্তু যদি একজন প্রতিবাদ করে, হাজার জন বদলাতে পারে।

Comments

    Please login to post comment. Login