তৃষা দাঁড়িয়ে ছিলো জানালার ধারে। দুপুরের রোদ এসে পড়েছিল তার গায়ে, কিন্তু তার মনটা ছিল প্রচণ্ড রকম অন্ধকার। সে গলা শক্ত করে বললো—
"আমি আরিয়ান এর জন্য আর অপেক্ষা করতে চাই না। আজই চলে যাই, আমান।"
তাকে এভাবে হতাশ হয়ে যেতে দেখে মিস্টার আমান একটুও আশ্চর্য হলেন না, শুধু চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলেন—আরিয়ান।
তিনি একবার তৃষার দিকে তাকালেন, তৃষার মুখে ছিল যন্ত্রণা আর অভিমান মেশানো এক অদ্ভুত নীরবতা।
তখন আমান ধীরে মাথা নেড়ে তৃষাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন, যেন বলছিলেন, "এই একটা কল, তারপর সব ঠিক করবো।"
কল রিসিভ করলেন।
ওপাশ থেকে আরিয়ানের গলা শোনা গেল—
"আমি খুব সমস্যায় পড়েছিলাম মিস্টার আমান। আমি এখনই আসছি। ৫-১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো। প্লিজ, তৃষাকে বলবেন, আমি আসছি।"
তার কণ্ঠে ক্লান্তি ছিল, ভেতর থেকে আসা এক অসহায়ত্বের ছাপ। যেন অনেকগুলো যুদ্ধ জিতে শেষমেশ সে ছুটে আসছে নিজের একমাত্র স্বপ্নকে ফিরে পেতে।
আমান ধীর গলায় বললেন,
"আসো, আরিয়ান। আমরা অপেক্ষা করছি।"
এরপর ফোনটা কেটে দিলেন। এক মুহূর্ত নীরবতা... তারপর আমান তৃষার দিকে ফিরে তাকিয়ে হালকা করে বললেন—
"আরিয়ান আসছে। আর একবার তাকে শুনে নাও, তারপর সিদ্ধান্ত নিও।"
তৃষা কিছু বললো না। শুধু মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাতে কেউ তার চোখের ভিতরের বেদনা দেখতে না পায়।
.
অন্যদিকে—
আরিয়ান হেনাকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিয়েছে।
হেনা সারা রাস্তা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন বলতে চাইছে—
"আমারও তো কিছু ছিল বলার, শুধু একটা আলতো ছোঁয়া, কিন্তু সেই অধিকার নেই আমার।"
আরিয়ান গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু মনের মধ্যে চলেছে শত প্রশ্নের ঝড়।
"হেনাকে কোথায় রাখবো? কোথায় সে নিরাপদ থাকবে?"
অস্থিরতার মধ্যেও সে সিদ্ধান্ত নিল—
"আমি বস আমান এর বাংলো বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছি। তৃষা যা-ই ভাবুক, আমি আজ সবকিছু খুলে বলবো। হেনার জীবন ঝুঁকিতে—এটা ওর জানার প্রয়োজন আছে।"
গাড়ির স্পিড একটু বাড়িয়ে দিলো আর কল করলো মিস্টার আমানকে।
বাংলো বাড়ির রাজকীয় প্রাচীর পেরিয়ে যখন আরিয়ানের গাড়িটি প্রবেশ করলো, তখন দিনের আলো বেশ তীব্র—
প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেছে।
তৃষা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলো।
ভেতরটা তখনো কাঁপছে অজানা আশঙ্কায়।
অভিমানে জমে থাকা চোখ জলে নোনতা হয়ে আছে।
তবুও একটুকরো আশার আলো তার মনের মাঝে স্পষ্ট,
"হয়তো আজ সব ঠিক হয়ে যাবে..."
ঠিক সেই সময়ই গেটের শব্দ।
গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার আওয়াজ।
দারোয়ান গেট খুলে দ্রুত গিয়ে রিসিভ করলো।
সম্মানের সঙ্গে দরজাটা খুলে বললো—
“স্যার, দেরি হয়ে গেছে... ভেতরে সবাই অপেক্ষা করছে।”
আরিয়ান কোন কথা বললো না।
চোখ লাল, চেহারায় স্পষ্ট অস্থিরতা।
গাড়ির আরেকদিক থেকে নামল একটা মেয়ে—হেনা।
শরীর কাঁপছে, চোখ নিচু,
মুখে কষ্ট লুকোনো এক কুয়াশা।
হেনার হাতটা ধরে রেখেছে আরিয়ান।
একটা সুরক্ষা যেন দেয়ার চেষ্টা করছে,
কিন্তু সেই হাত ধরা দেখতেই
তৃষার বুকটা ধক করে উঠলো।
সে জানালার কাছ থেকে একটু এগিয়ে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়াল।
চোখ বড় বড় করে তাকালো…
তার চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস।
“ও একা নয়…”
একটা মেয়ে তার হাত ধরে হাঁটছে—
আরিয়ানের হাত!
তৃষার মনে মনে প্রশ্নের ঝড়,
"ও কে?"
"আরিয়ানের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক?"
"আজও কি আরেকটা ধোঁকা?"
মিস্টার আমানও দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
তার ভেতরেও অদ্ভুত একটা প্রশ্ন ছায়া ফেলেছে—
“এই মেয়েটি কে?”
আরিয়ান তৃষার চোখের দিকে তাকালো,
তৃষা চোখ সরিয়ে নিলো…
কিন্তু বুকের ভেতর যেনো কিছু একটার চিৎকার শুরু হয়েছে।
হেনা তখনো কাঁপা কাঁপা পায়ে দাঁড়িয়ে, কারও চোখে তাকাতে পারছে না।
তার চোখে অনুরোধ— "আমাকে বিচার করো না..."
আরিয়ান জানে, আজ সে কিছু না বললে
সব ভেঙে যাবে।
তারপরও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে,
তৃষা, আরিয়ান, মিস্টার আমান—তিনজনের মাঝে
চোখে চোখে এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
চলবে....