পোস্টস

গল্প

আনন্দম

২৭ মে ২০২৪

নূহা চৌধুরী

মূল লেখক নূহা চৌধুরী

একটা চিঠি লিখেছি। খুব সাহস করে। কি বোর্ডে ঝড় তুলে যে কাজ করা যায় সেটা হাতে লেখার কারণ আছে। অর্পিতা নিজেকে খুব ওল্ড স্কুল বলে। তাহলে ওর চিঠিই পছন্দ হবার কথা। ব্যাপারটা বেশ রোমান্টিক আমারও মনে হয়।
অর্পিতা আমার কলিগ। নীল বোর্ডের দেয়াল ছাপিয়ে আমি ওকে দেখি। ফর্সা গোল গাল মুখ। টিকালো নাক। প্রসাধনহীন চেহারা। বেশ মনোযোগী প্রোগ্রামার। অফিসে আসে ডেস্কে বসে মিটিং শেষ করে বাড়ি ফিরে যায়। তাই ক্যান্টিনে যখন তখন আমাদের চা খাবার বায়না আর কাজ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেবার পায়তারাতে ওকে খুঁজে পাইনা। সাধারণ একটা চুপচাপ মেয়ে কেমন করে যেন আমার মনে ধরে গেল।
ভাবছেন আড্ডা না হলে কেমন করে জানি সে ওল্ড স্কুল? প্রোফাইল ফটোয়ের ওপরে এত্ত বড় করে কভার ফটোতে লিখে রেখেছে। তাও কত বছর আগে। ফি মাসে একটা করে ছবি বদলায় না। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে ব্ল্যাক কফি খায়। ইনসট্যান্ট কফি আমার দু চোখের বিষ। কিন্তু লাল টুকটুকে একটা মগে এক চামচ কফি দিয়ে মেয়েটা এত চমৎকার করে এ বস্তু গিলতে থাকে। আমার চোখ সরে না।
ঘটনা প্রথম লক্ষ্য করলো রাসেল। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো
বস! এত মেয়ে থাকতে এইটা! এই মেয়ে বড় হয়ে অমরেশ পুরী হবে! দেখিস না কথাবার্তা বলে না!
ছাতা। এই মেয়ে বড় হয়েই আছে। সেটা তুই দেখিস না? কেমন মিষ্টি করে হাসে? গ্যাঁজদাঁত আছে। সুন্দর।
এর তো মুখ থেকে কথা বের হয় না। তুই হাসতে দেখলি কখন?
রাসেল এটা আসলে ঠিক বলেনি। মেয়েটার সাথে কথা বলতে গেলে এই একটা ব্যাপারই হয়। কিছু বললে ঠোঁট টিপে মিষ্টি করে হাসে।
তাই তার টেবিলের সামনে যেয়ে উঁকিঝুকি মেরে
আরে অর্পিতা ব্যস্ত নাকি?
অর্পিতা আজ আমাদের কফি খাওয়াবে!
কিংবা
অর্পিতা একা একাই লান্চ করছেন?
এসব বলে কেউ সুবিধা করতে পারে না। ডেস্কে গুছিয়ে রাখা ফাইলের স্তুপ, ফটো ফ্রেমে বোনের বাচ্চার একটা ছবি, চামড়া বাঁধানো নোটবুক ইত্যাদি ছাপিয়ে মাথা গুঁজে মনিটরে পড়ে থাকা অবাক মেয়েটা শুধু মনে দাগ কেটে যায়। কেন মেয়েটাকে এত ভাল লেগে গেল তাও বুঝতে পারিনা। ভালোবাসা কি এরকম? হুট করে এসে বাসা বেঁধে ফেলে মনে? তারপর ক্রমেই মেলতে থাকে ডালপালা?
রাসেলের ভাষ্যমতে এসবই শুধুই ইনফাচুয়েশন। নাহলে অফিসের ডাকসাইটে সুন্দরী এইচ আর ডানাকাটা মিলি থাকতে অর্পিতা কে দেখে খাবি খাচ্ছি কেন? পাত্তা দেয়না বলেই তো! মিলি ভীষণ সুন্দর। এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই। দুনিয়ার তাবৎ অফিসের সব এইচ আরের জীবন ছাই হয়ে যাবার কথা এম্প্লয়িদের অভিশাপে। মিলির ক্ষেত্রে তা হবে না। হবে উল্টো। মিলির জীবন ছাড়খার হবে এম্লয়িদের দীর্ঘশ্বাসের জন্য। মেয়েরা মিলি কে হিংসা করে আর ছেলেরা ফেলে দীর্ঘশ্বাস। এক অর্পিতাকে দেখলাম মিলির সাথে মাঝেমাঝে গল্প করতে। আমার বন্ধু রাসেল বলেছেন-
অর্পিতা আসলে মিলিকে হাতে রাখে। এইচ আরের সাথে যার বন্ধুত্ব তার থেকে দূরে থাকাই উত্তম কাজ।
আমি উত্তম কাজটি করতে পারছিনা। চাচ্ছিও না। মিলির প্রফাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সে বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। অফিসটা ঈদের ছুটি হয়ে যাবে শীঘ্রই। অর্পিতার জন্য সাত পাঁচ ভেবে দুটো বই অর্ডার করে ফেললাম। ঈদে উপহার আমি দিতেই পারি।
কিন্তু বই দেবার আগেই দূর্ঘটনা ঘটে গেল। মানে এমন বাজে একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সেটা আমি চিন্তাও করতে পারিনা।
আমার ক্লস্ট্রফোবিয়া আছে। বাজে ধরনের। এই যে মেট্রো রেইল হয়েছে অফিসে যাবার পথে তার একটা স্টেশনের নীচ দিয়ে আমার মাঝেমাঝে যেতে হয়। নীচে যখন চারপাশে বাস বাইক ইত্যাদি দিয়ে বোঝাই হয়ে যায় আমার তখন মনে হয় আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো। মানে আমার অ্যাটাকটা হয় তখনই যখন বন্ধ জায়গার সাথে অন্ধকারও থাকে। এটা জানি বলেই ঐ রুট টা যতটা পারি আমি এড়িয়ে চলতে চাই। বাতাস কেমন আতংকের নাম আমার জন্য।
অফিসের সামনে বসে বেনসনের শলাকা পোড়ানোর পাশাপাশি চাও খাচ্ছিলাম। মেঘলা দিন। বেনসন সুইচের মেন্থলের অংশটা বেশ একটা ভাব এনে দেয়। মনটা বেশ উড়ু উড়ু।অর্পিতার জন্য লেখা চিঠিটা পকেটে। এটা ড্রাফট। এর মধ্যে ডেলিভারীম্যান কল দিয়েছে। বই গুলো চলে এসেছে। ব্যাটাকে সামনে রেখেই বই চেক করে নিয়েছি। সাবধানের মার নেই। ছেঁড়া ফাটা হলে ইজ্জতের ব্যাপার বইকি! দাম চুকিয়ে ড্রাফট টা বসিয়ে দেখলাম। ঠিকঠাক ফিট হয় কীনা বইয়ের ভেতর।
আরে সাব্বির বস!
হাঁক শুনে তাকিয়ে দেখি রাসেল হেলতে দুলতে আসছে। ব্যাটাকে ছাপিয়ে নীচে এসেছিলাম। কেন যেন অর্পিতার কথা শুনলেই নেগেটিভ হয়ে যায়।
তোমার ম্যাডাম তো সুন্দরী মিলির কাছে ছুটির দরখাস্ত দিছে! বাড়ি নাকি আগে আগে যাবে?
রাসেলের কথা শুনে বিষম লেগে গেল! আজই?
হুম। আজকেই। তোর ফোনটা দে ত। জরুরী কল করা লাগবে একটা। আমার ফোনের চার্জ নাই। কেবলটাও রেখে আসছি বাসায়।
চায়ের বিল রাসেলের উপর ফেলে দিয়ে তড়িঘড়ি করে লিফ্টে চাপলাম। এখন ও আসল চিঠি লেখা হয়নি।
দোতলায় আসতেই লিফ্টের ডোর খুললো। কে যে কল দেয়! পারলে প্রতি ফ্লোরে একবার থামে। ভাল লাগে না। তাড়াহুড়োর সময় এসব যন্ত্রনা….
লিফটের দরজায় অর্পিতা। মনটা খারাপ হতে যেয়ে ভাল হয়ে গেল।
কি অর্পিতা খবর ভালো? আগেআগে ছুটি নিচ্ছো শুনলাম।
অর্পিতা উত্তরে মিষ্টি করে হাসলো। ঠোঁট টিপে। গ্যাঁজদাঁতটা দেখা হলো না। লিফ্ট তরতর করে উপরে উঠছে। আমাদের ফ্লোর ছ’তলা। মনে হলো বিল্ডিংটা কেন বিশ তলা হলো না? আমাদের ফ্লোরটাই যদি সবচেয়ে উপরে হতো…
ভাবনার পারদ আকাশে চড়াতে শুরু করে উঠতে পারিনি। লিফ্টের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সব ঠান্ডা। আমি অর্পিতাকে সাহস দিতে বললাম-
এক্ষুণি কারেন্ট চলে আসবে। ভয় পেয়ো না।
অর্পিতা আস্তে করে বললো-
আমি ভয় পাচ্ছি না সাব্বির ভাই। অসুবিধে নেই। মোবাইলটা উপরে রেখে এসেছি। আপনি ফ্ল্যাশটা জ্বালাবেন?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
পকেটে হাত দিয়ে আমার ঘাম ছুটে গেলো! ফোন তো রাসেলের কাছে। হা রা ম জা দা থেকে তো ফোন নেয়া হয়নাই! আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। স্মার্ট ওয়াচ জানান দিচ্ছে সময় পার হয়েছে মাত্র দেড় মিনিট। লিফট এখনও চালু হয়নি।
অর্পিতা।
অর্পিতাকে ডেকে আমি ঢোঁক গিললাম।
ইয়ে আমার ফোনটা রাসেলের কাছে। ত… তুমি ভয় পেও না। কারেন্ট চলে আসবে।
বলতে বলতে আমার গলা কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি অ্যাটাক হচ্ছে। দম নিতে হচ্ছে বড় করে।
অর্পিতা কি বুঝলো কে জানে? এসে আমার হাত ধরে ফেললো। বললো-
সাব্বির ভাই, আপনি ঠিক আছেন?
চোখ বন্ধ হবার আগে আমি চোখের সামনে তারা ঝিলমিল দেখতে পেলাম। হাতের বই গুলো খসে পড়লো লিফ্টের মেঝেতে।
****
ঈদের ছুটির পর আজ অফিস খুলেছে। মরমে মরে যাচ্ছি। জ্ঞান হারানোর আর জায়গা খুঁজে পেলাম না। অর্পিতার সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। মেয়েটাও যেন কেমন। পাষাণ টাইপ। রাসেলের সাথে এখন আমিও একমত। ঈদে বাড়ি গেছে ভাল কথা। একটা খোঁজ নেবে না? কোন খোঁজ নিলো না। কারেন্ট আসার পর সবাই ধরাধরি করে যখন বাইরে নিলো বই গুলো তখন হারিয়ে গেছে।
হারায় তো আর নি। অফিসের কেউই গাপ করে দিয়েছে। সুযোগ মত নিশ্চয়ই বো ম ফাটাবে। ওসব ভেবে আর কাজ নেই। নিজের ডেস্কে মুখ আমসত্ব বানিয়ে বসে ছিলাম। সকাল থেকে সবাই
সাব্বির ভাই এখন ভাল?
জিজ্ঞেস করে করে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিয়েছে। অর্পিতা আসেনি এখনও। রাসেলের কাছে সবার খবর থাকে। ওকে জিজ্ঞেস করলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলবে-
ওমন হার্টলেস মেয়ের কথা আর জিজ্ঞেস করবি না তো!
রাসেল কীভাবে সব খবর রাখে চিন্তা করতে করতে চমকে উঠলাম। ওর সাথে মিলির কোন চক্কর নেই তো! মিলির কথা বললেই ব্যাটা ইদানীং বেশি গদগদ হয়ে যায়। রাসেলের ডেস্কের দিকে তাকালাম। ব্যাটা হাসি হাসি মুখে কাকে যেন টেক্সট করছে।
অর্পিতা এসে নিজের ডেস্কে না গিয়ে আমার ডেস্কের সামনে চলে এলো। আমি অর্পিতা কে দেখলে এ্কটু ভাবে থাকবো ভেবেছিলাম। খোঁজই নিলো না। কিন্তু খেয়াল করলাম আমি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলছি-
কি অর্পিতা? সব খবর ভাল?
ও বললো-
সাব্বির ভাই।খবর তো আপনার কাছে। ঐদিন যে কান্ড করলেন। এত ভয় পায় নাকি মানুষ?
আমার দাঁত বন্ধ হয়ে গেল। আচ্ছা মেয়ে তো। কই খোঁজ নেবে। তা না। লেগ পুল করছে। অর্পিতা আবার বললো-
আপনার দুটো বই আমার কাছে। ঐদিন যে পড়ে গিয়েছিলেন। আমি অবশ্য বই গুলো আজ নিয়ে আসিনি।
বই অর্পিতার কাছে আছে শুনে আমি খুশি না বেজার হবো বুঝতে পারছিলাম না। কি মুসিবতের কথা। এখন ওকে আমি কি বলবো? এই বই ওর জন্য? নাকি বলবো ফেরত নিয়ে আসতে? অসহায় হয়ে রাসেলের দিকে তাকালাম। সে শ্রাগ করলো। শুধু বিড়ি ফুঁকার সময় কাজে আসে ব্যাটা। আমি হাসি হাসি মুখ করে অর্পিতার দিকে তাকালাম। বললাম-
সমস্যা নেই। সমস্যা নেই।
অর্পিতা আবার হাসলো। যে হাসিতে কাঁচভাংগা ঝমঝম আওয়াজ নেই। তবু হৃদয় কাটে বারবার।অর্পিতা ডেস্কের দিকে এগুলো। আমার মনে হলো আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচালাম। ফেরত যেতে যেতে আবার ফিরে এলো মেয়েটা।
চিঠিটা পড়লাম সাব্বির ভাই। এক পাতার চিঠিতে চারটা বানান ভুল?
আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম ওর দিকে। আর রাসেল তাকালো আমার দিকে। ওর ও চোখ ছানাবড়া!
এক কাজ করি সাব্বির ভাই। আপনাকে চিঠি সমেত বই গুলো দেই। আপনি বানান ঠিকঠাক করে আমাকে আবার দিয়ে দিয়েন? বই গুলো তো আমার জন্যই নাকি?
হাসলো মেয়েটা।মিষ্টি করে। ঐ যে গ্যাঁজদাঁত দেখা যাচ্ছে। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। আমার মনে হলো বুক থেকে একটা পাষাণ নেমে গেলো। আহ! বাতাসে এত আনন্দ থাকে!