এই সরকারের হাতে সময় খুব বেশি নেই। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও গোপালগঞ্জ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত অন্তর্বর্তী প্রশাসন নিজেদের সদিচ্ছার পরিচয়ে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে। অপরাধীরও মানধিকার থাকে। অথচ গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের যেন কোনো অধিকারই নেই।
‘নিষিদ্ধ’ ছাত্রলীগের নাম টেনে পুরো গোপালগঞ্জবাসীর ওপর ভয় ও আতঙ্কের ছায়া নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এ দেশের নাগরিক হিসেবে গোপালগঞ্জের মানুষেরা রাষ্ট্রের তরফে এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ পাওনা ছিল না।
১৬ জুলাইয়ে এনসিপির 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' কর্মসূচিতে স্থানীয়দের হামলায় এনসিপি নেতৃবৃন্দের ‘ইগো’ হয়তো খানিকটা আহত হয়েছে, কিন্তু তাদের শরীরে আঁচড়টুকু পর্যন্ত লাগেনি। বিপরীতে, গোপালগঞ্জের পাঁচজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় কষ্টে দিন পার করছেন। হাজারো মানুষ মামলা খেয়েছেন। আর সবার ওপরে, সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারছেন না। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এ অবস্থায় কিছু ইউটিউব অ্যানার্কিস্ট সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন গোপালগঞ্জের পানি-বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার! এ কি জাতিগত বিদ্বেষ নয়? কেবল গোপালগঞ্জে জন্মেছে বলেই কি এখানকার শিশুদের অমানবিক শাস্তি পেতে হবে? এক বাবাকে কেন দুধ কেনার জন্য বাজারে যেতে দেওয়া হবে না?
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত আবশ্যক। অথচ সরকার গুলিবিদ্ধ নিহতদের দাফন করেছে ময়নাতদন্ত ছাড়াই। এখন বলছে, প্রয়োজনে লাশ উত্তোলন করা হবে! হে রাষ্ট্র, একটি পরিবারকে তুমি আসলে কতবার হত্যা করবে?
তোমরা স্বীকার করো শেখ মুজিব স্বাধীনতার নেতা ছিলেন। অথচ প্রশ্ন তোলো তাঁর শাসন নিয়ে? তিনি তো ওই প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে -পরিবারসহ। তাহলে একজন মানুষকে একই অপরাধে কতবার বিচার করবে তুমি? একটি কবর গুঁড়িয়ে দিলে কি মুজিবের স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে যাবে?
এই দেশ গোপালগঞ্জ ছাড়াও আরও বড় সংকটে আছে। সেই প্রেক্ষাপটে গোপালগঞ্জই আসল ইস্যু নয়। জুলাই শহীদ আবু সাইদের হত্যার বিচার আজও হয়নি। জুলাই আন্দোলনের বহু আহত এখনো বঞ্চনার ভারে ক্লান্ত। দেশের সর্বত্রই জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত।
গতকাল এনসিপি কক্সবাজারে গিয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গডফাদার ও চাঁদাবাজ বলে আখ্যা দিলে, স্থানীয় বিএনপি কর্মী ও জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। একইভাবে, গোপালগঞ্জে এনসিপি যখন "মুজিববাদ নিপাত যাক" স্লোগান দেয়, বঙ্গবন্ধুর কবর নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করে, এবং জেলাকে হেয় করে কথা বলে, তখন আওয়ামী লীগ ও সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।
উভয় ক্ষেত্রেই এনসিপি নেতাদের সেনা নিরাপত্তায় এলাকা ছাড়তে হয়। কিন্তু পরিণাম কি এক?
কক্সবাজারে কোনো কারফিউ জারি হয়নি, কোনো দমন অভিযান চালানো হয়নি। অথচ গোপালগঞ্জে চলছে কারফিউ, চলছে গণগ্রেফতার, হাজারো মানুষের নামে মামলা।
এই বৈষম্য আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করে -রাষ্ট্র কি রাজনৈতিক আবেগে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে? কেবলমাত্র শেখ মুজিবের জন্মস্থান বলেই কি গোপালগঞ্জকে অ্যান্টি-স্টেট এলাকা হিসেবে দেখবে রাষ্ট্র?
রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া যখন ভারসাম্যহীন হয়, তখন কি গণতন্ত্র আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে না?
আসলে, রাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতা ও পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াই তাকে সাম্য, ন্যায় এবং গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত করছে। জুলাই গণ-আন্দোলনে তো আমরা এই বৈষম্যেরই অবসান চেয়েছিলাম! তবে সেই পরিবর্তন এখনও অধরা রইল কেন?
এমন কঠিন বাস্তবতায় গোপালগঞ্জ ইস্যু কি ইচ্ছাকৃতভাবে এতটা উস্কে তোলা হচ্ছে, যাতে আরও জরুরি জাতীয় সংকটগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায়?
লেখক: সাংবাদিক
২০ জুলাই ২০২৫
56
View