পোস্টস

চিন্তা

গল্পগুলো আমার ভাবনারই বসতবাড়ি

২৭ মে ২০২৪

মুহসীন মোসাদ্দেক

মূল লেখক মুহসীন মোসাদ্দেক

আমি গল্প নিয়ে ভাবি অথবা গল্প আমাকে দিয়ে ভাবায়—দুভাবেই বলা যায়। অর্থাৎ, গল্পের সঙ্গে ভাবনার একটা বন্ধন প্রতীয়মান। একটা গল্প শুরুর পূর্ব থেকে শেষ করা পর্যন্ত ভাবনার নানা দরজা খুলে খুলে এগোতে হয়! গল্প শেষ হয়ে যাবার পরও পেরোতে হয় ভাবনার বেশ কিছু দরজা। একটা গল্প যখন ভাবতে শুরু করি তখন এক সমুদ্র-তুল্য ভাবনার ভিড় জমে যায়! সেখান থেকে দু-চার ঘটি জল-তুল্য ভাবনাই কেবল তুলে আনা সম্ভব হয়! অর্থাৎ এক সমুদ্র-তুল্য ভাবনা থেকে কেবল দু-চার ঘটি জল-তুল্য ভাবনাই শব্দে রূপ পায়! বাকি ভাবনা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়! এ অপূর্ণতা বা অতৃপ্তি সম্ভবত সব লেখকের বেলাতেই প্রযোজ্য। একরাশ ভাবনার যৎসামান্যই শব্দের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারে!
আমার ভাবনাগুলো সরল। ভাবনাগুলোর প্রকাশও তাই সরল। আমার ভাবনা ও অভিজ্ঞতার সরল প্রকাশই ঘটে আমার গল্পে। প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাহিনি এবং চরিত্রকে অবলম্বন করি। কখনো কাহিনি দিয়ে চরিত্র গড়ি, কখনো চরিত্র দিয়ে কাহিনি। কাহিনি ও চরিত্রের যুগপৎ যোগাযোগে গল্পের শরীর গড়ে ওঠে। একটা গল্প নিয়ে যখন ভাবতে থাকি আমার চারপাশে তখন একটা ঘোরের মতো পরিবেশ তৈরি হয়! আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে বাস করি। এই ঘোরের ভেতরে আমার ভাবনাগুলো শব্দের অবয়বে একে একে নিজের জায়গা করে নিতে থাকে! নিজ নিজ জায়গায় চুপটি করে বসে পড়ে একটি গল্প নির্মাণ করে ফেলে! ঘোরের ভেতর থেকে ফিরে এসে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, আমার ভাবনাগুলোর শাব্দিক রূপ! কী যে এক মায়া জেগে ওঠে তখন, শব্দগুলোর প্রতি; মনে হয় ছুঁয়ে দেখি, একটু আদর করে দিই! শব্দগুলো তখন যেন কেবল শব্দ নয়, আমার সন্তানের দেহের একেকটি কোষ, একেকটি অঙ্গাণু! কখনো কখনো ভাবতে ভাবতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘোর চলে আসে। তবে, এ ঘোর সবসময় অনায়াসে ধরা দেয় না! কখনো কখনো ভাবনাগুলোকে শব্দের অবয়ব দিতে আমাকে সেই ঘোরের অপেক্ষা করতে হয়। যতক্ষণ না আমার চারপাশে ঘোরেরা আনাগোনা শুরু করে ততক্ষণ কোনো ভাবনাই শব্দের রূপ নিতে পারে না! যে পর্যায়ে ভাবনার সাথে ঘোরের মিলন ঘটে, ভাবনার সেই পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। এ অপেক্ষা মিনিট কয়েকের হতে পারে, ঘণ্টা কয়েকের হতে পারে আবার অপেক্ষায় অপেক্ষায় মাস-বছরও পেরিয়ে যেতে পারে! ভাবনাগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত একটা ঘোরের সংস্পর্শ না পায় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। ভাবনাগুলোর তখন কোনো ঠিকানা থাকে না! এভাবে কত যে ভাবনা ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে উড়ে চলে গেল দূরে, আর ফিরে এল না—তার কোনো হিসাব কোথাও নেই!
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন গল্প লিখি? আমার ব্যক্তিগত উত্তর—‘ভাবনা’র কারণেই লিখি, লিখতে হয় কিংবা লিখতে বাধ্য হই! প্রতিটা মানুষই নিজের ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত ভাবতে থাকে। নানা ধরনের, নানা পর্যায়ের ভাবনার সঙ্গে বসবাস আমাদের। কোনো মানুষ ভাবনাবিহীন একটা মুহূর্ত কি কাটাতে পারে! খুব সম্ভবত নয়। ভাবনার সংক্রমণে এমনও হয়, হয়তো কখনো কখনো আমরা নিজেরাও টের পাই না ভাবনার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে আছি! ভাবনা আমাদের তার গর্ভে ডুবিয়ে রাখে! আমরা প্রতিনিয়ত ভাবনার গর্ভে সাঁতরে বেড়াই! অধিকাংশ মানুষই ভাবনাগুলো নিয়ে বিশেষ একটা ভাবে না! ভাবনার একটা দরজা পেরিয়ে আরেকটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে পরবর্তী দরজাগুলো অতিক্রম করে যেতে থাকে। পেছনের দরজায় আর ফেরে না! কিন্তু আমার মতো কিছু অভাগা মানুষ ভাবনাগুলো পেছনে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে না। ভাবনাগুলো নিয়ে আরেক ভাবনার অবতারণা করে। ভাবনাগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে চায় না, মুছে যেতে দিতে চায় না! ধরে রাখতে চায়। আর তা ধরে রাখতেই দারস্থ হয় কাগজ-কলম অথবা কী-বোর্ডের। ভাবনাগুলো ধরে রাখতে সেগুলোকে শব্দে রূপ দেয়। ভাবনাগুলো শব্দের ফুল হয়ে ফুটতে থাকে। রঙ ছড়াতে থাকে, আলো ছড়াতে থাকে, জীবন হয়ে উঠতে থাকে! আর তাতেই জন্ম হয় গল্পের, কবিতার বা মন যা চায় তেমন কিছুর।
গল্প-কবিতাগুলো তাই আর আলাদা কিছু নয়—লেখকের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ, লেখকের মননের গহীন জগতের দৃশ্যমান শাব্দিক রূপ। লেখক তার ভাবনাগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারে না বলে লেখার টেবিলে নিজেকে সোপর্দ করে। লেখার ভেতর দিয়ে নিজের ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দেয়। আমার ভাবনাগুলোও শব্দের পর শব্দে গেঁথে গল্পের ভেতরে বসত গড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। আমার গল্পগুলো আর কিছু নয়—আমার ভাবনার বসতবাড়ি!


শব্দসংখ্যা: ৫৯৯
১৮ মে, ২০১৫
মুহসীন মঞ্জিল, রাজশাহী