বরেণ্য ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান এক মহাশৈল্পিক জীবন সম্পন্ন করলেন। বাংলার আনাচেকানাচে রেখে গেলেন তাঁর শ্বাশ্বত পদচিহ্ন।
৭৯ বছর বয়সী এই শিল্পীর মহাপ্রয়াণে গভীর শোক ও অতল শ্রদ্ধা জানাই।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনারের স্থপতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় স্মারক স্মৃতিসৌধের স্থপতি হলেন সৈয়দ মইনুল হোসেন। বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই দুটি ভাস্কর্যের বাইরে দেশে যার কাজ অনন্য উৎকর্ষতায় ভাস্বর তিনি হলেন হামিদুজ্জামান খান।
মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় বাঙালির বীরত্বগাথা স্মারকভাস্কর্য হিসেবে শিল্পমাধ্যমে তুলে ধরবার অন্যতম কারিগর হামিদুজ্জামান। আমাদের চিরায়ত বাংলার গৌরবময় শাশ্বত চেতনা জাগরুক রাখবার অনন্য বাতিঘর চিত্রকর তিনিই।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে এক দৃপ্তপ্রতিম ভাস্কর্য -ডান হাতে গ্রেনেড, বাঁ হাতে রাইফেল, মালকোচা লুঙ্গি পরা, খোলা গায়ে, দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলা পেশিবহুল এক মুক্তিযোদ্ধা। এটি ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ -বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের স্মারক ভাস্কর্যের ইতিহাসে প্রথম, এবং এখনও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতীক।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই, তৎকালীন জয়দেবপুরে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (বীরবিক্রম) এই ভাস্কর্য নির্মাণের মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বেদিসহ ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি -এ যেন এক নির্ভীক প্রতিজ্ঞার দৃশ্যমান উচ্চারণ।
কংক্রিট, ধূসর ও সাদা সিমেন্টের ঢালাইয়ে নির্মিত এ ভাস্কর্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম। শিল্পী আবদুর রাজ্জাক এবং তাঁর সহযোগী হিসেবে হামিদুজ্জামান খানের সৃজনশীল হাতে ১৯৭২ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পন্ন হয় এই কালজয়ী নিদর্শন।
‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ শুধুমাত্র একটি ভাস্কর্য নয় -এ এক ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের প্রতীক, বাঙালির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার অমর স্মারক।
অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের সম্মুখে অবস্থিত 'সংশপ্তক' ভাস্কর্যটি এক অনবদ্য সৃষ্টি- স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর সন্তানের প্রতীকরূপে যার অবস্থান দৃঢ় ও গৌরবময়।
লাল সিরামিক ইটের চার স্তরের বেদির ওপর স্থাপিত এই ব্রোঞ্জনির্মিত ভাস্কর্যের উচ্চতা ১৫ ফুট। ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে এ ভাস্কর্য উন্মোচিত হয়। এর নির্মাতা ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।
এই শিল্পকর্মে চিত্রায়িত হয়েছে এক যুদ্ধবিধ্বস্ত বীরের প্রতিকৃতি -শত্রুর আঘাতে এক হাত ও এক পা হারিয়েও তিনি বন্দুক হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে অবিচল দাঁড়িয়ে আছেন। পঙ্গুত্ব তাঁর সাহসকে দমাতে পারেনি; বরং তিনি হয়ে উঠেছেন বিজয়-আকাঙ্ক্ষার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি -নির্ভীক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং শত্রুমুক্ত স্বদেশের স্বপ্নে উদ্দীপ্ত।
‘সংশপ্তক’ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ -যে বীর নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কা জেনেও মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে লড়াই চালিয়ে যান। এই ভাস্কর্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেইসব অকুতোভয় যোদ্ধার কথা, যাঁরা জীবন-মৃত্যুর হিসাব না করে স্বাধীনতার মানচিত্রে নিজেদের রক্তে লিখেছেন মুক্তির ইতিহাস। শত্রুর নির্মম আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েও তাঁরা পিছু হটেননি; কারণ তাঁদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট -মুক্ত এক মাতৃভূমি।
ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী ও সংশপ্তক শিল্পী হামিদুজ্জামান খানকে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চির অমরত্ব দিয়েছে।
জয়দেবপুর চৌরাস্তায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’ ছাড়াও ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিজয় কেতন’, মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন প্রাঙ্গণে ‘ইউনিটি’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ‘ফ্রিডম’, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা চিরন্তন’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানায় ‘জাগ্রত বাংলা’, আগারগাঁওয়ে সরকারি কর্মকমিশন প্রাঙ্গণে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, মাদারীপুরে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ হামিদুজ্জামান খানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য।
হামিদুজ্জামান খান বিচিত্র মাধ্যম ও ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি ধাতু, কাঠ, সিরামিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিরীক্ষাধর্মী অনেক ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। ধাতব মাধ্যমে পাখির ভাস্কর্য বিনির্মাণ তাঁর অন্যতম সৃজনশীল কাজ। টিএসসি চত্বরে ধাতব মধ্যমে করা ‘শান্তির পায়রা’সহ পাখি নিয়ে তাঁর অনেক ভাস্কর্য রয়েছে।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, 'ভাস্কর্যের পাশাপাশি তিনি জলরঙের ছবিতেও বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। তাঁর জলরঙের নিসর্গ, মানব মানবীর মুখাবয়ব ও নিরীক্ষাধর্মী কাজগুলো বিদগ্ধ মহলে খুবই সমাদৃত হয়েছে। দেশ-বিদেশে তাঁর ভাস্কর্য ও চিত্রকলার প্রায় অর্ধশত একক ও বহু যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে। হামিদুজ্জামান খান ২০০৬ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক পান। তিনি বাংলা একাডেমি ফেলো ছিলেন। এ ছাড়া দেশ বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক হিসেবে বর্ণাঢ্য এক জীবন অতিবাহিত করেছেন। বহু শিষ্যের মন ও মনোজগতে শিল্প-দর্শনের কঠিন কাঠামো গেথে দিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম বিনির্মাতা এই মহান মানুষ হামিদুজ্জামান খানকে যুগ থেকে যুগান্তরে মনে রাখবে এই বাংলাদেশ এবং এখানকার বিদগ্ধ ও শিল্প অন্তপ্রাণ অন্ত্যজ মানুষেরা।
লেখক: সাংবাদিক
২০ জুলাই ২০২৫