এক বরষায়,
৩য় ও শেষ পর্ব
পরেরদিন সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল রাতুল এর, চোখ খুলে দেখে মা তার মাথায় হাত রেখে বলছে, কিরে আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ বাবা ফ্রেশ হয়ে নে, তোর না আজ কনফারেন্স!তা হ্যাঁ রে বাবা তোকে কেমন আজ ভীষণ আনমোনা লাগছে,তোর তো আজ খুশি হবার কথা,তোর স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, তুই কি কিছু লুকোচ্ছিস আমার থেকে? যাই হোক এখন সময় নেই তোর তুই রেডি হয়ে নে রাতে সবটা বলবি আমায়,আর হ্যাঁ যাওয়া র সময় আমাকে একটু তোর ছোট ফুপুর বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবি,এত বছর পর ঢাকায় এসে সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগছে রে , সত্যিই তাই সবকিছু কেমন যেন পরিবর্তন হয়েছে রাতুল এর ই চিনতে সমস্যা হচ্ছিল কালকে , কোন কিছুই আর আগের মতো নেই এই দশ বছরে কত কিছুই না পরিবর্তন হয়েছে এই দশ বছরে একবারও ঢাকায় আসা হয়নি, ছোটবেলা থেকে যে শহরে বেড়ে ওঠা সেই শহরেই আজ অচেনা, হ্যাঁ তাই অচেনা, তিন্নি মারা যাবার পরে রাতুলের অবস্থা খুব বেশি খারাপ হওয়ায় রাতুল কে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চট্টগ্রামে তার বাবার বাসায় চলে গিয়েছিল রাতুল এর মা দশবছর আগে ফেরা হয়নি আর, আজও হয়তো বা ফেরা হতো না কিন্তু একটা ব্যবসায়িকদের জরুরী কনফারেন্স এর জন্য ঢাকায় আসা এত বছর পর নিজের বাড়িতে আসবে বলে মা বায়না ধরে বসলো তাই মাকেও নিয়ে আসা,
রাতুল এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মাকে নামিয়ে দিয়ে হোটেল শেরাটনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে সেখানে আজ ছোট বড় সব কোম্পানির মালিকদের বৈঠক আজ হ্যাঁ রাতুল আজ একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন ঠিক তিন্নির বাবার মত, তিন্নি যেমনটি চেয়েছিল, ঠিক তেমনি,আজ রাতুল অনেক বড় একজন ব্যবসায়ী শুধু তিন্নিই পাশে নেই, তিন্নির স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে রাতুল এই দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী তিন্নি মারা যাবার পর রাতুলের মা পাগল প্রায় রাতুলকে নিয়ে রাতুলের নানার বাড়ি যাবার কিছুদিন পর রাতুল এর নানা পরলোকগমন গমন করেন, রাতুলের নানা মারা যাবার পর রাতুলের নানার বিশাল সম্পত্তি দুভাগে ভাগ হয়ে যায় কারণ রাতুলের মায়েরা দুই বোন ছিল, রাতুল এর মা ও খালা দুজন মিলে নানার ব্যাবসায় বসিয়ে দেয় রাতুলকে, কয়েক বছরেই রাতুল ব্যবসাটি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে , রাতুল গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্ট্রিস এর মালিক এখন রাতুল, তিন্নি স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে কিন্তু তিনি তো পাশে নেই , পাশে নেই ঠিকই কিন্তু তিন্নির বাবা তো জানবে? আচ্ছা তিন্নির বাবার বাবাও কি এই অনুষ্ঠানে আসবে দেখা হবে তার সাথে দেখা হলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে রাতুল আজ আজকে আর মাথা নিচু করার সময় নয়,এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চলে এসেছে রাতুল গাড়িটি পার্ক করে ভেতরে প্রবেশ করল রাতুল সেখানে সব দেশ-বিদেশের বড় বড় কোম্পানির মালিকরা রয়েছে রাতুল একটি টেবিলে আসন গ্রহণ করলো কিছুক্ষণ পর পাশের টেবিলে ই চোখ পড়তে রাতুলের বুকটা যেন কেঁপে উঠল, রাতুল আবার তাকালো ভদ্রলোকের দিকে ভদ্রলোক একদৃষ্টে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছে, সেই ভদ্রলোক আর কেউ নয় তিন্নির বাবা পাশে বসা তিন্নির ভাই, ভদ্রলোক আর আগের মত নেই যে চোখে সব সময় রাগ দেখেছে রাতুল সেই চোখ যেন আজ করুন দৃষ্টি রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছে, রাতুল এবার চোখ সরিয়ে নিল কিন্তু রাতুলের চোখে আজ আর কোন ভয় নেই নেই কোন সংশয় যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে তাদের সাথে তাদের রাস্তায়, কনফারেন্স শেষ না হতেই রাতুল খেয়াল করল তিন্নির ভাই তিন্নির বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আগের মত শরীরে আর শক্তিটুকু নেই কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না ভদ্রলোক, কনফারেন্স শেষ করে রাতুল বেরিয়ে পড়ল একটা প্রশান্তি নিয়ে, কিছুক্ষণ যেতেই সেই প্রশান্তি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল কালকের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল মনের ভিতর, এবার পা বাড়ালো তিন্নির খোঁজে সেই রহস্য উদঘাটন করতে এবার এই রহস্যের জটলা না খুলে সে ঢাকা থেকে ফিরবে না,
যেই কথা সেই কাজ, রাতুল সোজা গাড়ি নিয়ে তিন্নির বাড়ির সামনে গিয়ে প্রায় এক ঘন্টা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো , একবার মনে হচ্ছে বাড়ির ভেতরে চলে যাবে সে , কোন এক অজানা ভয় ভয়াবহ অতীত তাকে বারবার আটকিয়ে দিচ্ছে, রাতুল বাহিরেই অপেক্ষা করতে লাগলো , একসময় রাতুল এর চোখে পড়ল প্রায় বছর ছয় সাতেকের একটি ছেলে ব্যাট আর বল হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো, ছেলেটি এসে বাইরে সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দিল, রাতুল ভাবল ছেলেটির সঙ্গে একটি সখ্যতা গড়ে নিয়ে বাড়ির খোঁজ খবরটা যদি একটু নেয়া যায় তিন্নির কথা যদি একটু শুনে নেয়া যায়, রাতুল এবার গাড়ি থেকে নেমে ছেলেগুলোর সাথে ক্রিকেট ব্যাট হাতে খেলতে শুরু করে দিল তারপর খেলা শেষে এক পর্যায়ে ছেলেটি সঙ্গে কিছু আলাপচারিতা শুরু করে দিল রাতুল প্রথমে ছেলেটির নাম তারপরে তার পরিবার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে করতে এক পর্যায়ে সে বলল যে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো সেই বাড়ির সাথে সম্পর্ক তার কি?
অবশেষে জানা গেল যে ছেলেটি ওই বাড়ির ছোট ছেলে,মানে তিন্নির ছোট ভাইয়ের ছেলের বন্ধু, গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে রাতুল প্রশ্ন করল যে ওই বাড়িতে কে কে থাকে, ছেলেটি এক এক করে সবার কথা বলে যাচ্ছে রাতুলের যেন হার্টবিট বেড়ে যেতে লাগলো ছেলেটি এক পর্যায়ে বলে উঠলো যে সবচাইতে থাকে বেশি আদর করে তিন্নি ফুপি,
রাতুলের হার্টবিট যেন আরো বেড়ে গেল, তিন্নি তাহলে বেঁচে আছে? এ কি করে সম্ভব? রাতুলের যেন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তিন্নি যদি বেঁচেই থাকবে তাহলে তাকে সেদিন কেন ফেলে রেখে এসেছিল একা আর কেনইবা খোঁজ নিলো না কেনই বা রাতুলের জীবনে ফিরল না, কেনই বা সেদিন বাড়ির দারোয়ান বলেছিল যে তিন্নি হয়তোবা আর বেঁচে নেই, প্রায় এক মাস ধরে তিন্নির বাসা র সামনে বসে কাটিয়েছে সে ,না সে আর বসে থাকতে পারছে না ছেলেটিকে বিদায় জানিয়ে সে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গেল কিন্তু সারারাত একটুও ঘুমাতে পারল না শুধু এটাই ভেবে চলল গতকাল যে ভদ্রমহিলাকে দেখেছিল সেই আসলে তিন্নি ,বেঁচে আছে তিন্নি, তার ভালোবাসা কি মিথ্যে ছিল ? নাকি পরিবারের চাপে রাতুলের কাছে আসতে পারেনি? আচ্ছা তিন্নি কি রাতুল এর ই আছে? নাকি তিন্নির বিয়ে হয়ে গিয়েছে, হয়তো বা তিন্নির ছেলে-মেয়েও আছে, না ,সামনাসামনি তাকে হতেই হবে হাজারো প্রশ্ন যে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রাতুল এর,
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বেরিয়ে পড়ল,আজ সে সব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ছাড়বে ,গাড়ি গিয়ে সোজা তিন্নিদের বাসার সামনে দাঁড়ালো , রাতুল এবার গাড়ি থেকে নেমে সোজা তিন্নিদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, না আজ ভেতরে যাবে সে তিন্নির বাবার মুখোমুখি সে হবেই আজ ,আজ আর কোন ভয় নেই আজ শুধু রাতুল নয় সে এখন রাতুল গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক,
রাতুল সদর দরজা পেরিয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে পৌঁছালো তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে দেয়া হলো, কিন্তু না সে বসবে না,কারো কথার তোয়াক্কা না করে সরাসরি অন্দরে ঢুকে গেল সবেমাত্র সকালের নাস্তা সারছিল সবাই টেবিল ভর্তি লোকজন সবাই খাচ্ছে,তিন্নির বাবাও আছে সেখানে শুধু কল্পনার তিন্নিকেই চোখে পড়ল না রাতুলের, রাতুল এবার তিন্নির বাবার চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালো কিন্তু একি মানুষটির চোখে আর কোন অহংকার নেই, আছে শুধু অনুতাপ আর অপরাধবোধ, রাতুল কিছু বলে ওঠার আগেই তিন্নির বাবা বলে উঠলেন বাবা তুমি সেই রাতুল না? চলো ভিতরে গিয়ে বসে কথা বলা যাক, মানুষটার কন্ঠে আজ সিংহের মতো গর্জন নেই, রাতুল কে বাবা বলে সম্বোধন করছে রাতুল আর অবাক না হয়ে পারল না, আমি বসতে আসিনি, আমি শুধু জানতে চাই আমার তিন্নি কোথায়?
তিন্নি বেঁচে আছে?
ভদ্রলোক এবার বললো তিন্নি আছে, তিন্নি বেঁচে আছে,
তারপর সেই অন্ধকার রাতের কাহিনী বলতে লাগলো ভদ্রলোক, আসলে সে দিন রাতে এক্সিডেন্টের পর তিন্নির ভাইয়েরা রাতুলকে রাস্তায় ফেলে রেখে গুরুতর আহত অবস্থায় তিন্নিকে নিয়ে চলে চলে আসে তারা ভেবেছিল তিনি আর বেঁচে নেই কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ডঃ জানায় যে, তিন্নি এখনো বেঁচে আছে হাসপাতালে একদিন থাকার পর তিন্নির কোন জ্ঞান না ফেরায় ডক্টর জানায় যে দেশের বাইরে নিতে হবে তখন তিন্নিকে নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া হয়, তিন্নির জ্ঞান ফিরতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়,
যেহেতু জানা ছিল যে তুমি বেঁচে আছো কম আহত হয়েছো তাই যেকোনো সময় তিন্নির খোঁজ নিতে আসতে পারো এই সুযোগে আমরা সবাই বাড়ি ছেড়ে দেশের বাইরে থাকি আর দারোয়ানকে দিয়ে তোমাকে বলাই যে তিন্নি আর বেঁচে নেই যাতে করে তোমাদের সম্পর্কটা সেখানেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তিন্নি সুস্থ হবার পর তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি, নিজের মেয়ের সঙ্গে আর পেরে উঠতে পারিনি , নিজের মেয়ের সাথে তো আর যুদ্ধ করা যায় না,মেয়েটা আমার সারা জীবন একাই কাটিয়ে দিল শুধু তোমার অপেক্ষায় তোমাকে হাজারবার খুঁজে ও আমরা তোমাকে খুঁজে পাইনি তোমার কোন খোঁজ খবর পাইনি শুধু সেই রাতে ঘটনার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা তোমার তিন্নি এখনো তোমারি আছে যাও তিন্নি হয়তোবা এখন ছাদেই আছে,
রাতুল আর অপেক্ষা করতে পারল না এক দৌড়ে ছাদে দরজায় গিয়ে পৌঁছালো, রাতুল এবার দাঁড়িয়ে পড়ল তার পুরো শরীর যেন কাঁপছে, খুশিতে যেন সব হারিয়ে ফেলেছে পায়ের শক্তিটাও যেন হারিয়ে গিয়েছে কথা বলা শক্তিটাও নেই, দাঁড়িয়ে দেখছি তিন্নিকে খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে তিন্নি ফুল গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল বর্ষাকাল হাওয়ায় হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমে এলো তিনি দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরতে লাগলো রাতুল যেন এই দৃষ্টির উপভোগ করতে করতে কখন যেন তিন্নির পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাতের নিচে হাত রেখে বলল আবারও সেই বরষায় তোমার সাথে আমার দেখা, তিন্নির হাতের সাথে কারো হাতের স্পর্শ পেতে তিনি যেন বিদ্যুৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো একদম রাতুলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে, এবার তিন্নি মাথা তুলে তাকালো তিন্নি যেন বিশ্বাস করতে পারছে না মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে সে,,সেই হাসিমুখ,
তুমি তুমি বেঁচে আছো? তুমি আমার ই আছো তো? এতোটা বছর আমাকে অপেক্ষা করালে?
তারপর খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাতুলকে, রাতুল ও যেন প্রান ফিরে পেল,
বর্ষার সজীবতা যেন দুজনকে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে দিল: ঠিক যেমন নিষ্প্রাণ গাছগুলো বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায় ঠিক তেমনি:
এক বরষায় তাদের প্রথম দেখা, আবার সেই বরষায় তাদের মিলন: